দারুল উলূম দেওবন্দের শায়খুল হাদীস ও সদরুল মুদাররিসীনি মুফতী সাঈদ আহমদ পালনপুরী রহ.-র স্মৃতিচারণমূলক প্রবন্ধ

বিগত ২৫ শে রমজান ১৪৪১ হিজরী, মোতাবেক ১৯ শে মে ২০২০ ইংরেজী মঙ্গলবার হিন্দুস্তানের সময় অনুযায়ী ভোর ৭:৩০ মিনিটের দিকে মুম্বাই শহরের একটি হাসপাতালে দারুল উলূম দেওবন্দের শায়খুল হাদিস ও সদরুল মুদাররিসীন আমার প্রাণাধিক প্রিয় হযরতুল উস্তায মাওলানা মুফতি সাঈদ আহমদ পালনপুরী (রহঃ) মাত্র কয়েকদিন অসুস্থতায় ভোগে আপন প্রভুর চুড়ান্ত ডাকে লাব্বাইক বলে দিলেন। এবং তার প্রাণবায়ূ এ নশ্বর জগত থেকে চিরস্থায়ী জগতের দিকে উড়াল দিয়ে চলে গেল। ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন।

তিনি ছিলেন ইসলামী বিশ্বের একজন আদর্শ ব্যক্তিত্ব, প্রখ্যাত হাদিস বিশারদ, অতুলনীয় মুফাসসির, সর্বজন স্বীকৃত মুফতি, হাদিস, তাফসির ও ফিকহের নীতিশাস্ত্রবিদ, নজিরবিহীন উস্তায, উস্তাযুল আসাতিযা, উস্তাযুল উলামা, হযরত ইমামুল হিন্দ শাহ ওয়ালী উল্লাহ মুহাদ্দিসে দেহলভী (রহ.) এর জ্ঞানভান্ডার ও চিন্তা চেতনার নির্ভরযোগ্য ও স্বীকৃত ব্যাখ্যাকার, হুজ্জাতুল ইসলাম কাসিমুল উলুমি ওয়াল খায়রাত হযরত মাওলানা কাসিম নানুতবি (রহ.) এর জ্ঞানভান্ডার এবং প্রজ্ঞা ও দর্শনের প্রকৃত ভাষ্যকার, ইমামুল ফুকাহা ওয়াল মুহাদ্দিসীন, ফকিহুন নাফস, ইমামে রব্বানি আবু হানিফায়ে ছানী হযরত মাওলানা রশীদ আহমদ গাঙ্গুহী (রহ.) এর জ্ঞানভান্ডার ও চিন্তা চেতনার উপযুক্ত ধারক বাহক, আকাবীরে উলামায়ে দেওবন্দের নীতি ও আদর্শের সত্যিকার অতন্দ্র প্রহরী এবং আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের জীবন্ত প্রতিচ্ছবি।
যখন হযরতুল উস্তায (রহ.) এর চিরবিদায়ের সংবাদ ওয়াটসঅ্যাপ এবং টেলিগ্রামের মাধ্যমে পুরো পৃথিবীজুড়ে ভাইরাল হল, তখন সাথে সাথেই এ মর্মান্তিক দুঃসংবাদ শুধুমাত্র দারুল উলুম এবং উপমহাদেশই নয় বরং পুরো ইসলামি বিশ্বকেই একদম শোকাহত ও মর্মাহত করে দিল।
এ হৃদয়বিদারক সংবাদটি পুরো পৃথিবীজুড়ে ছড়িয়ে থাকা হযরতুল উস্তায (রহ.) এর সকল শিষ্য, ভক্ত ও অনুরাগী যারা হযরত (রহ.) এর থেকে সরাসরি অথবা কোন মাধ্যমে উপকৃত হয়েছেন সবার অন্তরকে একদম অস্তির ও নিস্তেজ করে দিয়েছে।
এ অধম আফগানিস্তানে থেকেও হযরতুল উস্তাযের মৃত্যুর কিছুদিন পূর্ব পর্যন্ত তার সাথে ধারাবাহিক যোগাযোগ রেখে আসছিল। রমজানুল মুবারকেও তারাবীহ পরবর্তী বয়ান ও তাফসীর একদম শুরু থেকেই শুনে আসছিল। এবং এসব থেকে অনেক বেশী উপকৃত হচ্ছিল।
১২ ই রমজান হযরত মুফতি সাহেব (রহ.) হঠাৎ অসুস্ত হয়ে পড়েন। জ¦র এতই প্রবল ছিল যে, হযরতুল উস্তাযের একাধারে চার ওয়াক্ত নামাজ কাজা হয়ে যায় এবং একারণে তেরো তম রজনীতে হযরত বয়ান করতে পারেননি। যার ফলে সেদিন আর ওয়াটসঅ্যাপে হযরতের বয়ান প্রচারিত হয়নি।
পরদিন তেরো রমজান সকাল এগারো টার দিকে যখন আমার চোখ খুলল। তখন দেখলাম পাকিস্তান জামিয়া ইসলামিয়া বিন্নুরী টাউনের উস্তাযে হাদিস হযরত মাওলানা আবদুর রউফ সাহেব (দাঃবাঃ) যিনি হযরত মুফতি সাহেব (রহ.) এর অত্যান্ত স্নেহভাজন শিষ্য, তার নিকট থেকে আমার মোবাইলে বার্তা আসল যে “মাওলানা হেকমত উল্লাহ সাহেব! গত রাতে হযরত মুফতি সাহেব (দাঃবাঃ) এর বয়ান হলনা। কারণ কি? আল্লাহ না করুন হযরত আবার অসুস্ত হয়ে পড়লেন না তো?” আমি উত্তর পাঠালাম যে, “আমি ভাইদের (অর্থাৎ হযরতের সাহেবজাদাদের) সাথে যোগাযোগ করে কিছুক্ষনের মধ্যেই আপনাকে জানাচ্ছি ইনশাআল্লাহ” অতঃপর কয়েকবার হযরতের সাহেবজাদাদের নাম্বারে যোগাযোগ করলাম, কিন্তু কারো সাথেই আর কথা বলা সম্ভব হলনা। শেষ পর্যন্ত মাগরিবের কিছুক্ষণ পূর্বে আর ধৈর্য্য ধরতে না পেরে সরাসরি হযরতের নাম্বারেই কল দিয়ে বসলাম। আলহামদু লিল্লাহ হযরত ফোন উঠালেন। হযরতের আওয়াজ শুনামাত্রই আমার অন্তরটা প্রশান্তিতে ভরে গেল। আমি জিজ্ঞাসা করলাম “হযরত! গত রাতে কি আপনার বয়ান হয়নি? আমি তো প্রতি রাতেই আপনার বয়ান শুনি” তখন হযরত মুফতি সাহেব (রহ.) বললেন “গতকাল অসুস্ত হয়ে পড়েছিলাম, এজন্য বয়ান করতে পারিনি। এখন কিছুটা উন্নতি হয়েছে। ইনশাআল্লাহ আজ বয়ান করব।” আমি হযরতকে অনুরোধ করলাম আজও বয়ান বন্ধ রাখুন। আজ একটু বিশ্রাম নিন। হযরত বললেন “না ভাই! আজকে বয়ান করব” আমি হযরতের পাহাড়সম হিম্মত সম্পর্কে পূর্ব থেকেই অবগত, তাই বললাম ঠিক আছে হযরত।
যেমন কথা তেমন কাজ। হযরত তারাবীর নামাজের পর অসুস্থতা সত্ত্বেও বয়ান করলেন। খুতবাহ পাঠ করার পর সর্বপ্রথম গত রাতে বয়ান না করার কারণ বর্ণনা করলেন এবং এ অধমের ফোনালাপের কথাও তার যবান মুবারক দ্বারা উল্লেখ করলেন। এটা আমার মত একজন নগন্য ব্যক্তির জন্যে বিরাট গর্ব ও সৌভাগ্যের বিষয় এবং এ অধমের প্রতি হযরত (রহ.) এর অপার স্নেহ-মমতার অপূর্ব নিদর্শন।
যাহোক, অতপর পরবর্তী রাতেও হযরতুল উস্তায (রহ.) বয়ান করলেন। ব্যস, এটাই ছিল হযরতের জীবনের শেষ বয়ান। সর্বশেষ বয়ানে ইসলামের গুরুত্বপূর্ণ আকীদা “খতমে নবুওয়াত” সম্পর্কে আলোচনা করলেন। আবার রমজানের শুরু থেকে যেহেতু এ বয়ানের ধারা “দারসে কুরআন” এর শিরোনামে ছিল, তাই সে ধারাবাহিকতায় সুরা ফাতেহা থেকে শুরু হয়ে সুরা বাকারার পাঁচ নং আয়াতের أولئك هم المفلحون (অর্থাত ওরাই সফলকাম) এর তাফসীর পর্যন্ত এসে সমাপ্ত করলেন। আল্লাহু আকবার!! যার সারাটি জীবন কেটেছে তাকওয়ার উপর অবিচল থেকে, তার জীবনের শেষ বয়ানে তাকওয়ার অধিকারীদের ব্যাপারে বর্ণিত কুরআনের ঘোষণা أولئك هم المفلحون (অর্থাত ওরাই সফলকাম) উচ্চারিত হওয়া যেনো এদিকেই ইঙ্গিত বহন করে যে নিঃসন্দেহে তিনিও সফলকাম বান্দাদের অন্তর্ভুক্ত হয়েই পৃথিবী থেকে বিদায় নিচ্ছেন!
যাহোক এর পর ষোলতম রজনীতে হযরতের শারীরিক অবস্থা অবনতির দিকে যেতে লাগল। হযরতের সাহেবজাদা জনাব হাফিজ কাসিম আহমদ সাহেব (হাফিজাহুল্লাহ) এর তরফ থেকে একটি বার্তা সর্বত্র ভাইরাল হল যে “আমার ওয়ালিদে মুহতারাম হযরত মাওলানা মুফতি সাঈদ আহমদ পালনপুরী দামাত বারাকাতুহুম খুবই অসুস্থ, আজ তাকে ডাক্তারদের নিবিড় পর্যবেক্ষণে (আই সি উ তে) রাখা হয়েছে। শুভাকাঙ্খী সকলের নিকট হযরতের জন্যে দ্রুত সুস্থতার দোয়া চাই।”
এ বার্তাটি পুরো পৃথিবী জুড়ে ছড়িয়ে পড়ল। এবং হযরতের সকল শাগরিদ ও ভক্তবৃন্দকে এক ধরণের অস্থির ও ব্যাকুল করে তুলল। সকলেই আল্লাহর দরবারে কান্নাকাটি ও রোনাজারিতে লিপ্ত হয়ে গেলেন। ফলশ্রুতিতে আল্লাহর রহমতে দু-এক দিনের মধ্যেই হযরতের শারীরিক অবস্থা কিছুটা উন্নতির দিকে অগ্রসর হল।
কিন্তু পরক্ষনেই শারীরিক অবস্থার আবারো অবনতি ঘটে। এবং এবার প্রথম বারের চেয়ে আরো মারাত্নক আকার ধারণ করে। এবং ২৪ তম রমজান মুতাবেক ১৮ই মে সোমবার দিনে জনাব হাফিজ কাসিম ভাই এর পক্ষ থেকে আরো একটি বার্তা আসে, যা হযরতের সকল ছাত্র ও ভক্তবৃন্দকে একদম অস্থির ও নির্জীব করে দেয়। বার্তাটি এরকম ছিল যে “হযরত মুফতি সাহেব দামাত বারাকাতুহুম এর অবস্থা সিরিয়াস! হযরতের ফুসফুসে পানি একত্রিত হয়ে গেছে। যার কারণে নিঃশ্বাস নিতে অনেক কষ্ট হচ্ছে। এবং আজ হযরতের অবস্থা আশংকাজনক পর্যায়ে চলে গেছে। সকল পাঠকদের নিকট বিশেষ দোয়া প্রার্থনা করছি।”
উক্ত সংবাদটি পাওয়ার সাথে সাথেই হযরতের সকল ছাত্র, শুভানুধ্যায়ী এবং ভক্তকুল এমনকি সর্বস্থরের মুসলমানগনও হযরতের সুস্থতা ও নেক হায়াতের জন্যে মহান মাবুদের দরবারে দোয়া ও রোনাজারিতে নিমগ্ন হয়ে গেলেন এবং কায়মনোবাক্যে হযরতের হায়াত বৃদ্বির জন্য ভিক্ষা চাইতে লাগলেন। এ অধম তো এতই অস্থির ও অধৈর্য্য হয়ে পড়ল যে, সারা দিন ও রাতে একটি মুহুর্তও নিদ্রায় যেতে পারেনি। সারাক্ষণ শুধু কাঁদতেই আছি আর আল্লাহর দরবারে হযরতের হায়াত ভিক্ষা চাইতে আছি। কিন্তু আল্লাহর ফয়সালা হয়ে গিয়েছিল নিয়ে নেবার, তাই শেষ পর্যন্ত সেটাই হল। আমাদের প্রাণাধিক প্রিয় উস্তাদ আর আমাদের মধ্যে রইলেন না। আমাদের এতিম করে চিরদিনের জন্য অপারে চলে গেলেন।
একথা অনস্বীকার্য যে, হযরত মুফতি সাহেব (রহ.) এর ইন্তেকালে পুরো মুসলিম বিশ্ব, আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাত এবং বিশেষভাবে মাদরে ইলমী দারুল উলুম দেওবন্দের অপূরনীয় ক্ষতি হয়ে গেল। হক পন্থী সকল উলামায়ে কেরাম, ছাত্র সমাজ এবং সর্বস্থরের মুসলমানগন আজ হযরতের বিয়োগে ব্যথিত, ভারাক্রান্ত।
تیری وفات سے اے سعید وہ کون ہے جو نہ ہو غمگین
مگر تیری موت ناگہا ں کا مجھے ابھی تک نہیں یقین
তোমার ইন্তেকালে ব্যথিত নয় এমন কে আছে হে সাঈদ!
কিন্তু তোমার আকস্মাৎ মৃত্যুতে আমি এখনও হতে পারিনি নিশ্চত।
যখন আমাদের প্রাণাধিক প্রিয় উস্তাদ হযরত মুফতি সাহেব (রহ.) এর মৃত্যুসংবাদ আমার নিকট পৌঁছলো, তখন এ মর্মান্তিক ও হৃদয় বিদারক সংবাদে আমি একদম ধৈর্য্যহারা হয়ে পড়লাম। আমার অন্তরটা একদম ক্ষতবিক্ষত হয়ে গেল। নিজের অজান্তেই চোখ থেকে অজোর ধারায় অশ্রু বইতে শুরু করল। কাঁদতে কাঁদতে চোখের পানি গাল বেয়ে একদম দাড়ি পর্যন্ত ভিজিয়ে দিল। আমি অসুস্থ হয়ে একদম বিছানায় পড়ে গেলাম। কয়েকদিন যাবৎ আমার অবস্থা অপরিবর্তিত ছিল। এ সময়ে অনেক উলামায়ে কেরাম ও বন্ধু বান্ধব আমাকে বিভিন্নভাবে সান্তনা দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু আমার হৃদয় যে একদম ভেঙ্গে চুরমার হয়ে গিয়েছিল। আমি কোনভাবেই নিজেকে সংবরন করতে পারছিলাম না।
মাঝে মধ্যে মনে হত হযরতের স্মৃতিচারণ মূলক কিছু লিখি। তাতে অন্তর কিছুটা হলেও প্রশান্তি পাবে। কিন্তু যখনই কিছুটা লেখার ইচ্ছা করতাম তখনই আমার চোখ ঝাপসা হয়ে আসতো। পুরো পৃথিবীকে একদম অন্ধকার মনে হত। হিন্দুস্তান, আফগানিস্তান, ইরান এবং অন্যান্য রাষ্ট্র থেকে বিভিন্ন বন্ধু বান্ধব ও পরিচিতজন বার বার তাগাদা দিলেন যে এখন পর্যন্ত আপনার কোন সৃতিচারণ মূলক প্রবন্ধ আসেনি। আপনি তো ধারাবাহিক আট বছর পর্যন্ত হযরতের খেদমত করেছেন। নিয়মিত হযরতের মজলিসে অংশগ্রহন করেছেন। আপনি তো হযরতের জন্য পাগল ছিলেন। হযরতও আপনাকে অসামান্য ভালবাসতেন। এমনকি জীবনের শেষ দিনগুলোর বয়ানের মাঝখানেও আপনার কথা উল্লেখ করেছেন। অতএব অবশ্যই আপনার সাথে হযরতের অনেক স্মৃতি জড়িত রয়েছে। তাই সেসব বিষয় নিয়ে কিছু লেখা আপনার জন্যে আবশ্যক।
আমি সবাইকে একি কথাই বলেছিলাম যে আল্লাহ সাক্ষি, হযরত মুফতি সাহেব (রহ.) এর বিয়োগ ব্যথা আমার উপর এতই প্রভাব বিস্তার করেছে যে আমি নিজেকে কোনভাবেই আর স্থির রাখতে পারছিনা। নিজের উপর থেকে নিয়ন্ত্রন একদম হারিয়ে বসেছি। এই মুহুর্তে কিছু লেখা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। তবে শারীরিক ও মানসিক অবস্থা যখন কিছুটা উন্নত হবে তখন অবশ্যই কিছুটা লিখব ইনশাআল্লাহ।
হযরতের ইন্তেকালের প্রায় দুই মাস অতিবাহিত হওয়ার পর এখন মন মানসিকতায় অনেকটা মজবুতি এসেছে। এখন মনে হচ্ছে কিছুটা লিখতে পারব। তাই প্রাথমিক ভাবে কিছু অভিব্যক্তি ও সৃতি সম্বলিত একটি প্রবন্ধ লেখার ইচ্ছা করেছি। পরবর্তীতে বিস্তারিত আকারে একটি স্বতন্ত্র বই লেখার ইচ্ছা রয়েছে। আল্লাহ তাআলাই উত্তম তাওফীক দাতা।

হযরতের নৈকট্য অর্জন ও তার থেকে ইস্তিফাদাহ:
আল্লাহ তাআলার বিশেষ দয়া ও অনুগ্রহে আমার মত এক নগন্য ব্যক্তির ভাগ্যে ধারাবাহিক আটটি বৎসর হযরতুল উস্তায (রহ.) এর সান্নিধ্যে থেকে খেদমত ও ইস্তেফাদা করার সুযোগ হয়েছে। এজন্য মহান রবের দরবারে অজ¯্র শুকুর আদায় করছি।
প্রথম বৎসরটি ছিল আমার দাওরায়ে হাদিসের বৎসর। সে বৎসর যখনই হযরতের আসরের পরের মজলিসে যেতাম তখন একদম চুপচাপ বসে থাকতাম। হযরতের বিশাল ব্যক্তিত্ব এবং গাম্ভীর্যতার ভয়ে কিছুই বলতাম না। হযরত মাঝেমধ্যে ভাল মন্দ জিজ্ঞাস করতেন। আমি ভয়ে ভয়ে শুধুমাত্র “জি হযরত আলহামদুলিল্লাহ” বলেই চুপ হয়ে যেতাম এবং হযরতের কথাবার্তা অধীর আগ্রহের সাথে শুনতে থাকতাম।
দাওরায়ে হাদিসের বৎসর মাদরে ইলমীতে আমার প্রথম বৎসর ছিল। আবার ষাণ¥াসিক পরীক্ষার কিছুদিন আগে থেকে বৎসরের শেষ পর্যন্ত প্রতিদিন আসরের পর হযরত শায়খ আবদুল হক আ’যমী (রহ.) বুখারী শরীফ দ্বিতীয় খন্ডের দারস দিতেন। একারণে প্রতিদিন নিয়মিত আসরের পরে হযরতের ইলমী মজলিসে উপস্থিত হতে পারতাম না। তবে প্রতিদিন আসরের নামাজান্তে দারুল উলূমের প্রধান গেইটের সন্নিকটে ‘নওদারাহ’ তে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতাম যে হযরত শায়খ আবদুল হক আ’যমী (রহ.) আজ পড়াতে আসবেন কি না? যদি সংবাদ পেতাম তিনি আজ আসবেন না, তাহলে সাথে সাথেই হযরতুল উস্তাযের ঘরের দিকে দৌড় দিতাম। এবং দ্রুত গিয়ে হযরতের মজলিসে শরীক হয়ে যতটুকু সম্ভব ইস্তেফাদাহ হাসিল করতাম। মাঝে মধ্যে হযরত শায়খে ছানী (রহ.) আসবেন কি না এটা নিশ্চিত হতে অনেক সময় লেগে যেত, তখনও যদি মাগরিবের পূর্বে অন্তত পনেরো বিশ মিনিট সময়ও হাতে থাকত, তাহলে সাথে সাথে আমি দ্রুতবেগে রিক্সায় চড়ে হযরতের মুবারক ইলমী মজলিসেপৌঁছে যেতাম, যাতে করে কিছুটা হলেও হযরতের মূল্যবান নসীহত শুনে উপকৃত হতে পারি।
দাওরায়ে হাদিসের বৎসরটি এভাবেই কেটেছে। তবে দারুল ইফতার বৎসর থেকে নিয়ে বিগত বৎসর পর্যন্ত একাধারে সাতটি বৎসর নিয়মতান্ত্রিক ভাবে হযরতের মজলিসে উপস্থিত হওয়ার তাওফীক হয়েছে। আসরের আজানের সাথে সাথেই হযরতের ঘরে যাওয়ার নিয়ম করে নিয়েছিলাম। কখনও যদি হযরত বিশ্রামে থাকতেন তাহলে আমি জাগাতাম। হযরত উঠতেন। অজু করতেন। অতপর আসরের নামাজের উদ্দেশ্যে মসজিদে যেতেন। আমিও হযরতের সাথে সাথে যেতাম। নামাজান্তে হযরতের সাথে সাথেই এসে তার কামরায় প্রবেশ করতাম। ছাত্ররা একে একে এসে কামরা ভরে যেত। অতপর ছাত্ররা চিরকুটের মাধ্যমে হযরতের কাছে বিভিন্ন বিষয়ে ইলমী প্রশ্ন করত আর হযরত সেই সব প্রশ্নের জবাব অত্যান্ত সহজ সাবলীল ভাষায় দালীলিকভাবে বুঝিয়ে দিতেন। এভাবেই প্রশ্ন আর উত্তর চলত মাগরিবের আজান পর্যন্ত। সেই মজলিসে অবস্থানকালীন সময়ে যে কি পরিমাণ আন্তরিক প্রশান্তি মিলত তা ভাষায় প্রকাশ করার মত নয়।
আমি দেওবন্দে সর্বমোট আট বৎসর ছিলাম। দুই বৎসর একা একা আর বাকী ছয় বৎসর পরিবার সহ। ইফতার পরের বৎসর থেকে হযরতের সাথে সম্পর্ক ও ভালবাসা আস্তে আস্তে গভীর হতে শুরু করল। সাথে সাথে সংকোচহীনতা এবং স্বাভাবিকতা ও ধীরে ধীরে বাড়তে লাগল। এমনকি শেষের তিন চার বৎসর তো এতটাই স্বাভাবিক হয়ে গিয়েছিলাম যে, যেকোন ধরণের কথা এবং যেকোন প্রশ্নই একদম নির্দ্ধিধায় করতে পারতাম। হযরত (রহ.) ও অত্যন্ত স্নেহের সাথে আমার সব কথা শুনতেন এবং জবাব দিতেন।
যদি কখনও কোন কারণে দিল্লি যাওয়া হত এবং হযরতের মজলিসে উপস্থিত হতে পারতাম না তাহলে পরের দিন অবশ্যই হযরত (রহ.) অধমকে জিজ্ঞাসা করতেন “হ্যা ভাই মৌলভী হেকমতুল্লাহ! গতকাল কোথাও যাওয়া হয়েছিল নাকি?” আর যদি কখনও লাগাতার দু’দিন হয়ে যেত আর মজলিসে উপস্থিত হতে পারতাম না, তাহলে হযরতুল উস্তায (রহ.) নিজেই মোবাইল দিয়ে কল দিতেন এবং সালাম বিনিময়ের পর জিজ্ঞাসা করতেন “কোথায় আছ ভাই? দিল্লি নাকি অন্য কোথাও?” আমি যেখানে হতাম এবং যে প্রয়োজনে যেতাম হযরতকে বলে দিতাম। আর কখনও যদি হযরত কল দিয়ে জিজ্ঞাসা না করতেন তাহলে নৈকট্যশীল ছাত্র ভাইদেরকে অবশ্যই জিজ্ঞাসা করতেন “আল্লাহ জানে মৌলভী হেকমত উল্লাহ আজ কেন আসেনি। একটু খবর নিয়ে দেখতো!” সুবহানাল্লাহ! আল্লাহু আকবার! হযরতুল উস্তাযের এসব স্নেহ ও মমতার উপর আমার জীবন কোরবান হয়ে যাক।
যদি কখনও কোন অপারগতা বশত যেমন, পড়ানো ইত্যাদির কারণে মজলিসে যেতে দশ পনেরো মিনিট দেরী হয়ে যেত, আর আমি সালাম দিয়ে একদম পিছনে ঘরের কোন একটি কোণে চুপিসারে বসে যেতে চাইতাম, তখন হযরতের মায়াভরা দৃষ্টি অধমের উপর পড়তেই বলে উঠতেন “ওয়া আলাইকুমুস সালাম ওয়ারাহমাতুল্লাহ, আসো ভাই আসো, তোমার আসন খালি আছে” ছাত্রদেরকে বলতেন “ভাই! উনাকে সামনে আসতে দাও” অতঃপর অধমকে সম্বোধন করে বলতেন “কি ভাই কেমন আছো? পরিবার এবং সন্তানাদি সবাই কেমন আছে? কি হল আজ তোমার গাড়ি লেইট হয়ে গেলো?” অর্থাৎ আজ আসতে দেরী হল কেন? হযরতুল উস্তাযের ইন্তেকালের পর দীর্ঘ দিন পর্যন্ত এসব মমতাপূর্ণ আন্তরিক এবং অন্তরকে প্রশান্তি দানকারী সুমধুর আওয়াজ সমূহ বার বার কানে প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল। বিশেষত “আ’যাও ভাই আ’যাও” এর আওয়াজ। আমার ধৈর্য্য শক্তি একদম হারিয়ে গিয়েছিল। চক্ষুদ্বয় অশ্রুর বন্যা ভাসিয়েও যেন তৃপ্ত হচ্ছিল না। বার বার আল্লাহ তা’আলার নিকট আমি দোয়া করছিলাম যেন আল্লাহ আমাকে ধৈর্য্য ধরার তাওফীক দান করেন।
হযরতুল উস্তায (রহ.) এর সাথে সম্পর্ক ও নৈকট্য অর্জনের মূল কারণ তো ছিল হযরতের আপাদমস্তক ইলমী ব্যক্তিত্ব, কঠিন থেকে কঠিনতর বিষয়কে অতি সহজে বুঝিয়ে দেওয়ার বিরল যোগ্যতা, ধর্মীয় বিষয়ে দৃঢ়তার সাথে অবিচল থাকা, ধর্মীয় আত্মসম্মানবোধ, হক কথা নিদ্ধিধায় ও নির্ভয়ে বলতে থাকা, কোরআন সুন্নাহর প্রতি অসম্ভব প্রীতি ও ভালবাসা, হানাফী মাযহাবের উপর পূর্ণাঙ্গ পরিপক্কতা, পূর্ববর্তী সালাফের নীতি ও আদর্শে অত্যন্ত কঠোরতার সাথে অবিচল থাকা, সাহাবায়ে কেরাম (রা.) এর প্রতি সত্যিকার ভক্তি ও অনুরাগ এবং উনাদের মর্যাদার ব্যাপারে সজাগ দৃষ্টি, একদম সাদাসিধে জীবন যাপন, অত্যন্ত বিনয় ও নম্রতা এবং সুন্নাহ সম্মত জীবন যাপনের উজ্জল দৃষ্টান্ত সহ আরো অনেক অনন্য বৈশিষ্ট ও গুনাবলী।
আমি বিশ্বের অনেক বড় বড় ওলামায়ে কেরাম, মুফতিয়ানে এযাম, সুদক্ষ আসাতিযা, এমনকি মাদরে ইলমী দারুল উলূম দেওবন্দের আকাবীরগন যাদের একেকজন ইলমের একেকটি পাহাড় উনাদের থেকেও খুব ‘ইস্তিফাদাহ’ করেছি। কিন্তু খোদার কসম করে বলতে পারব এবং একথার মধ্যে কোন প্রকার বাড়াবাড়ি হবেনা যে, হযরত মুফতি সাহেব (রহ.) এর মত ব্যক্তিত্ব কাউকে পাইনি। হযরত মুফতি সাহেব (রহ.) এর মত ব্যক্তিত্ব শতাব্দিতে একজনই জন্মায়।
ফরাসী কবি আমির খসরুর ভাষায়;
آفاق ھاگر دیدہ ام مہر بتان ورزیدہ ام
بسیار خوبان دیدہ ام لیکن تو چیز دیگری
আমি পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে ঘুরে এসেছি, অনেক উত্তম ব্যক্তিত্বদের ভালোবেসেছি, অনেক সুদর্শন ও ভাল লোকদের দর্শন লাভ করেছি, কিন্তু তোমাকে সকলের থেকে ব্যতিক্রম পেয়েছি।
আমি এ কবিতাটি দু-তিন বার স্বয়ং হযরত মুফতি সাহেব (রহ.) কেও শুনিয়েছি। প্রত্যেকবারই হযরত বিনয় প্রদর্শন পূর্বক বলেছেন “আরে ভাই এজাতীয় কথা বলনা। আমার মধ্যে তো তেমন কিছুই নেই” আমি হযরতকে বলেছিলাম হযরত! এটা আপনার বিনয় ও শিষ্টতা, নতুবা আমি যা বলছি তাতে বিন্দুমাত্র বাড়াবাড়ি নেই। শতভাগ সত্য কথাই বলছি।
হযরত মুফতি সাহেব (রহ.) এর মধ্যে সবদিক দিয়ে পূর্ববর্তী সালাফের প্রতিচ্ছবি ফুটে উঠত। তিনি সালাফের মতই একসাথে মুহাদ্দিস, মুফাসসির, ফকীহ, মুতাকাল্লিম (আকাইদ শাস্ত্রবিদ), আদিব (আরবী ও উর্দু সাহিত্যক), এবং বিভিন্ন শাস্ত্রের ইমাম ছিলেন। এমনকি তিনি তাসাওউফের ও ইমাম ছিলেন। কিন্তু হযরত সর্বদা এটাকে গোপন রাখতেন।
ليس على الله بمستبكر أن يجمع العالم في واحد
পুরো বিশ্বের সকল জ্ঞানভাণ্ডার এক ব্যক্তির মধ্যে একত্র করা আল্লাহর জন্যে দুষ্কর কিছু নয়।

পাঠদান পদ্ধতি ও বুঝানোর বিরল যোগ্যতা:
আল্লাহ তাআলা হযরত মুফতি সাহেব (রহ.) কে কঠিন থেকে কঠিনতর বিষয় অত্যান্ত সহজতার সাথে বুঝিয়ে দেওয়ার বিরল যোগ্যতা দান করেছিলেন। ক্লাসে কিতাবাদি পড়ানোর ক্ষেত্রে, উলামায়ে কেরামের বিশেষ সেমিনারে, ফেকহী কনফারেন্সে, কিতাবাদী রচনার ক্ষেত্রে, ওয়াজ নসীহতের ময়দানে এবং সর্ব সাধারণ মানুষের মাহফিল সমূহে কঠিন থেকে কঠিনতর বিষয়কে এতো সহজ ও আকর্ষনীয় পদ্ধতিতে বুঝিয়ে দিতেন যে উপস্থিত প্রত্যেকটি মানুষের নিকট বিষয়গুলো একদম সুস্পষ্ট হয়ে যেত এবং তা হৃদয়ে পূর্ণরূপে প্রোথিত হয়ে যেত।
হযরত (রহ.) এ ব্যাপারে বলতেন যে, আমি এভাবে বুঝানোর পদ্ধতি আমার দু-জন উস্তাযের কাছ থেকে শিখেছি। প্রথমত; হযরতুল উস্তায মাওলানা সিদ্দিক আহমদ জাম্মু কাশ্মিরী (রহ.)। যিনি মাযাহিরে উলুম সাহারান পুরের উস্তায এবং নাহু শাস্ত্রের ইমাম হিসাবে প্রসিদ্ধ ছিলেন। দ্বিতীয়ত; আমার অত্যন্ত শ্রদ্ধাভাজন উস্তায ও মুরব্বী, উস্তাযুল আসাতিযা হযরত আল্লামা ইবরাহীম বলিয়াভী (রহ.)। যিনি দারুল উলুম দেওবন্দের সদরুল মুদাররিসীন এবং সাধারণ ভাবে ইলমী সকল শাস্ত্রে ও বিশেষ ভাবে মানতিক শাস্ত্রের ইমাম হিসাবে সর্বমহলে স্বীকৃত ছিলেন।
যেসব মাসাইলে প্রচ- রকমের মতানৈক্য রয়েছে এবং যেসব মাসাইলের সমাধানে বড় বড় উলামায়ে কেরামের ও নূন্যতম আট দশ পৃষ্টা ব্যয় হয়, সেসব মাসাইলকে হযরত মুফতি সাহেব (রহ.) মাত্র এক দুই পৃষ্টায় সমাধান করে ফেলতেন। আর যেসব মাসআলা অন্যান্য উলামায়ে কেরাম দু-তিন পৃষ্টার মধ্যে সমাধান করতেন, সেসব মাসআলা হযরত মুফতি সাহেব (রহ.) দু-তিন বাক্যের মাধ্যমেই সমাধান করে ফেলতেন।
হযরত মুফতি সাহেব (রহ.) এর সবক পড়ানোর পদ্ধতি এতই পরিপাটি সুনিপুন ও আকর্ষনীয় ছিল যে একাধারে দুই থেকে তিন ঘন্টা পর্যন্ত পড়াতেন কিন্তু ছাত্ররা একটি মুহুর্তের জন্যও কোন প্রকার বিরক্তি বোধ করত না।
কিতাব বুঝানো এবং ইবারত হল করে দেওয়ার ক্ষেত্রে হযরত মুফতি সাহেব (রহ.) এর কোন দৃষ্টান্ত ছিলনা। হযরতের কাছে পড়–য়া সকল ছাত্র এবং হযরত সম্বন্ধে অবগত উলামায়ে কেরাম সকলেই এ বিরল যোগ্যতার কথা বিনা বাক্যে স্বীকার করেন। চাই কুরআনে কারীমের কোন আয়াত হোক বা রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের) হাদিস, চাই ফুকাহায়ে কেরামের ইবারত হোক কিংবা উসুলে ফিকহের কোন মূলনীতি, এমনিভাবে চাই আকাইদ শাস্ত্রের ইবারত হোক কিংবা মানতিক ফালসাফা অথবা সৌরবিজ্ঞানের ইবারত, হযরত মুফতি সাহেব (রহ.) সর্ব প্রকার ইবারতেরই এমন ভাবে ব্যাখ্যা প্রদান করতেন যে ক্লাসের একদম দুর্বল ছাত্ররাই শুধু নয় বরং সাধারণ আম মানুষের জন্যও এসব কঠিন বিষয়গুলো একদম পানির মত সহজ হয়ে যেত।
যখন হযরতুল উস্তায (রহ.) বুখারী শরীফের দারস প্রদান করতেন তখন মনে হত যেন স্ময়ং ইমাম বুখারী (রহ.) এসে দারস দিচ্ছেন। হাদিসের সনদ নিয়ে আলোচনা করার সময় ইমাম যাহাবী (রহ.) ও ইবনে হাজার আসকালানী (রহ.) এর কথা স্মরন হয়ে যেত। উসুলে হাদিসের ব্যাপারে আলোচনাকালে আল্লামা ইবনে সালাহ (রহ.) র কথা স্মরণ হয়ে যেত। যখন রেওয়ায়েতে হাদিসের উপর আলোচনা করতেন তখন ইমাম মালিক (রহ.) এর কথা স্মরণ হয়ে যেত। যখন ফিকহুল হাদিস নিয়ে আলোচনা করতেন এবং হাদিসের পরস্পর বৈপরীত্বের চমৎকার সমাধান দিতেন তখন হযরতের মধ্যে ইমাম ত্বাহবী (রহ.) এবং আল্লামা ইবনুল হুমাম (রহ.) এর প্রতিচ্ছবি ফুটে উঠত।
মোটকথা হযরত মুফতি সাহেব (রহ.) উস্তায হিসাবে ছিলেন তুলনাহীন। যাকে ‘দারস ও তাদরীসের’ ইমাম বলা যায়। তিনি ছিলেন মাদরে ইলমী দারুল উলূম দেওবন্দের আসাতিযায়ে কেরামদের মধ্যমনি এবং ‘পাঠদান মসনদের’ সৌন্দর্য্য। একারণেই হযরত মুফতি সাহেব (রহ.) দারুল উলূম দেওবন্দের ছাত্রদের নিকট বরাবরই ছিলেন সর্বাধিক প্রিয় উস্তায এবং তার দারস ছিল সকলের নিকট গ্রহনযোগ্য ও আকর্ষণীয় দারস।
হযরত মুফতি সাহেব (রহ.) এর দারসের একটি নিয়ম ছিল যে তিনি বৎসরের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত কিতাবের বিসমিল্লাহ থেকে নিয়ে সর্বশেষ সবক পর্যন্ত পুরো বৎসর একই পদ্ধতিতে পড়িয়ে শেষ করতেন। শুধুমাত্র প্রথম দিকে দু-তিন মাস অনেক বেশী আলোচনা করে পরবর্তীতে নামমাত্র আলোচনার মাধ্যমে তাড়াহুড়া করে কিতাব সমাপ্ত করা কখনই হযরতের অভ্যাস ছিলনা। হযরত বলতেন আমি মনে করি শুধু ইবারত পড়িয়ে চালিয়ে যাওয়া হাদিসকে অবজ্ঞা করার নামান্তর। এজন্য হযরত (রহ.) কখনই কোন হাদিসের ব্যাপারে অন্তত কিছু হলেও না বলে পরের হাদিসে যেতেন না।

দারুল হাদিসে আগমন এবং হাদিসের মসনদে সমাসীন হওয়ার নয়নাভিরাম দৃশ্য:
হযরতুল উস্তায (রহ.) এর দারুল হাদিসে আগমনের দৃশ্য ছিল অনেক চিত্তাকর্ষক ও শানদার। দারুল হাদিসে আসার সময় হযরত তার বিশেষ জামা পরিধান করতেন। সাদা রঙ্গের আরবী জুব্বা যা হাটু ও ঘন্টার মাঝামাঝি থাকত। পায়জামা এবং সাদা গোল টুপি যা বিশেষ পদ্ধতিতে হযরতের ঘরেই তৈরী হত এবং সুন্নত মুতাবিক মাথার সাথে লেগে থাকত, তিনি তা পরে আসতেন। টুপির উপর সাদা রুমাল ব্যবহার করতেন। কখনও রুমালকে কাঁধের উপর রেখে আসতেন। কখনও পাগড়ি পরিধান করে তার উপর সাদা রুমাল পরে আসতেন।
যখন দারুল হাদিসে প্রবেশ করতেন তখন পুরো দারুল হাদিসে একদম সুনসান নীরবতা বিরাজ করত। হযরত লাঠিতে ভর করে শানদার ভঙ্গিমায় ধীরে ধীরে মসনদের দিকে এগিয়ে আসতেন। মসনদের নিকটে এসে সোজা দাঁড়িয়ে যেতেন এবং ছাত্রদের দিকে মুখ করে প্রথমে বলতেন আসসালামু আলাইকুম। অতপর পূর্ণ গাম্ভীর্যতার সাথে মসনদে আরোহণ করে চার যানু হয়ে বসতেন। দারস শেষ হওয়া পর্যন্ত হযরতের বসার এ ধরন পরিবর্তন হতনা। চাই যত ঘন্টাই দারস দেন না কেন। হযরতের এসব শানদার ও পূর্ণ গাম্ভীর্যতার সাথে আগমন, আরোহণ ও উপবেসনের কারণে ছাত্রদের অন্তরে অনুভব হত যে, আমরা অনেক বড় একজন মুহাদ্দিস ও ফকিহের সামনে বসে আছি।

যাবতীয় সফর সমূহ ছুটির দিনগুলোতেই হত:
হযরতুল উস্তায (রহ.) এর স্বভাব ও রীতি ছিল যে তিনি মাদরাসা চলাকালীন সময়ে বিভিন্ন কনফারেন্স এবং মাহফিল সমূহে অংশগ্রহনের উদ্দেশ্যে মোটেও সফর করতেন না। যতটুকু সম্ভব হযরতের চেষ্টা এটাই থাকত। চাই দেশের ভিতরের সফর হোক কিংবা বহির্বিশে^র। পড়ালেখা চলাকালীন সময়ে কোথাও যেতেন না। আমার নিজের চোখে দেখা অনেকবার এমন হয়েছে যে দেশের দুরদুরান্ত থেকে অথবা ইউরোপ বা আমেরিকা থেকে উলামায়ে কেরাম দেওবন্দ এসেছেন এবং বিশেষ কোন প্রোগ্রামের জন্যে হযরতকে দাওয়াত করেছেন কিন্তু হযরত সরাসরি উনাদেরকে না বলে দিয়েছেন। হযরত বলতেন “পড়ালেখা চলাকালীন সময়ে সফর করলে ছাত্রদের ক্ষতি হবে। আর আমি কোনভাবেই ছাত্রদের ক্ষতি করতে চাইনা।”
তবে কখনও যদি একান্ত কারণ বশত কোন প্রোগ্রামে উপস্থিত হতেই হত, তখন দেখা যেত যে হযরত (রহ.) ঐ দিনের সবক যাওয়ার পূর্বেই পড়িয়ে নিতেন। হযরত কোন উস্তাযের সাথে কথা বলে উনার ঘন্টায় পড়িয়ে নিতেন আর উনাকে বলতেন আমি যখন সফরে চলে যাব তখন আপনি আমার ঘন্টায় এসে আপনার কিতাব পড়িয়ে নিবেন। আর যদি কখনও সফরে যাওয়ার পূর্বে পড়ানোর কোন ব্যবস্থা না হত, তখন সফর থেকে প্রত্যাবর্তনের পর অবশ্যই ছুটে যাওয়া সবকের ক্ষতি পূরণ করতেন। চাই মাগরিবের পর হোক বা এশার পরে অথবা জু’মার রাতে যেকোন সময় পড়িয়ে ছুটে যাওয়া সবকের ক্ষতিপূরণ করেই তৃপ্ত হতেন। হযরত ছাত্রদের সময়ের প্রতি খুবই নজর রাখতেন। সত্যিকার অর্থেই তিনি ছিলেন ছাত্রদের প্রতি অত্যন্ত সদয় ও দয়াবান।

দারুল উলূমে খেদমত করতেন বিনা পারিশ্রমিকে:
হযরত মুফতি সাহেব (রহ.) শিক্ষকতা জীবনের শুরুতে গুজরাটের ‘সূরত’এ দারুল উলূম আশরাফিয়া রান্দের মাদরাসায় নয় বৎসর পর্যন্ত খেদমত করেছেন। তার পর থেকে মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত একাধারে আটচল্লিশ বৎসর দারুল উলূম দেওবন্দের উস্তায হিসাবে ছিলেন।
রান্দের মাদরাসায় থাকাকালীন তার সম্মানী ছিল যতসামান্য। হযরত তা গ্রহণ করতেন এবং শুধুমাত্র এর উপরই তার জীবন চলত। দারুল উলূম দেওবন্দে শিক্ষকতার প্রথম দিকে দারুল উলূম থেকেও সম্মানী গ্রহণ করেছেন।
কিন্তু কিছু দিন পরই যখন আল্লাহ তাআলা হযরতকে কিতাবাদি লেখার বরকতে কিছুটা অর্থ সম্পত্তি দান করলেন তখন সাথে সাথে হযরত মাদরাসা থেকে সম্মানী নেওয়া বন্ধ করে দিলেন এবং দারুল উলূম দেওবন্দ ও দারুল উলূম আশরাফিয়া থেকে যত রুপি সম্মানী হিসাবে নিয়েছিলেন সব রুপিও হিসাব করে ফেরত দিয়ে দিলেন!
ধর্মীয় আত্মমর্যাদাবোধ এবং সালাফের নীতিতে অনমনীয়তা
হযরত মুফতি সাহেব (রহ.) এর বিশেষ বৈশিষ্ট ছিল যে, কোন মন্দ বা সুন্নতের উল্টা কিছু দেখলে নীরব থাকতেন না। চাই দারুল উলূমের ভিতরে হোক বা দেওবন্দী ঘরনার অন্য কোন মাদরাসায় হোক অথবা মুসলিম সমাজের সাধারণ মানুষদের মাঝেই হোক না কেন। যেখানেই কোন অন্যায় বা সুন্নতের বিপরীত কিছু দেখতেন অথবা পূর্বসুরী আকাবীর ও আসলাফের নীতি-আদর্শের বিপরীত দেখতেন, সাথে সাথেই কোরআন হাদিসের দলিল প্রমাণের মাধ্যমে খন্ডন করে এর বিরুধীতা করতেন। এমনিভাবে হযরত সর্বপ্রকার বিদ’আতের সমালোচনাও করতেন। যেখানেই থাকতেন সব সময় বিদ’আতি কার্যক্রমের কঠোর সমালোচনা করতেন।
শরীয়ত বিরুধী কার্জকলাপ, বিদআত, বিভিন্ন প্রকার রসম-রেওয়াজ এবং গুমরাহ ফিরকাসমূহের ব্যাপারে নীরবতা এবং শুধু শুধু হেকমত অবলম্বন করাকে নাজায়েজ বরং ধর্মীয় ব্যাপারে উদাসীনতা শামিল মনে করতেন। এটি হযরতের ব্যতিক্রমী বৈশিষ্ট ছিল যে, তিনি সব জায়গাতেই এসবের বিরোধীতা করতেন। চাই দারুল উলূমের দারুল হাদিস হোক বা মজলিসে ইলমী, চাই মজলিসে আমেলা হোক কিংবা মজলিসে শুরা, চাই পুরা হিন্দুস্তানের রাবতায়ে মাদারিসের সম্মেলনে হোক বা যেকোন ইলমী অথবা সাধারণ মাহফিলে; হযরতের নিকট এসবের মধ্যে কোন পার্থক্য ছিলনা।
হযরত মুফতি সাহেব (রহ.) পূর্বসুরী আকাবির ও আসলাফের নীতি ও আদর্শের ব্যাপারে পূর্ণাঙ্গরূপে অবগত ও অত্যান্ত দৃঢ়তার সাথে অবিচল ছিলেন। এজন্যই দারুল উলূম দেওবন্দের মজলিসে শুরার আকাবীরগন দু-তিন বার হযরতুল উস্তাযের নিকট আবেদন করেছিলেন যে “দেওবন্দিয়্যাত কি?” এ ব্যাপারে যেন একটি সমৃদ্ধ কিতাব রচনা করেন। কিন্তু হযরত উনাদেরকে প্রত্যেকবারই বলেছিলেন এখন আমি তাফসীরে হেদায়াতুল কুরআন লিখছি, একসাথে দুই কাজ করব না। প্রথমে তাফসীর সমাপ্ত হোক, তার পর দেখা যাবে।
যেমন কথা তেমন কাজ, যখন হযরত মুফতি সাহেব (রহ.) তাফসীর সমাপ্ত করলেন তখন এ বিষয়ে কলম ধরার নিয়ত করে ফেললেন, এবং কিছু অংশ লিখেও ফেললেন, কিন্তু তাকদিরের ফয়সালা ছিল ভিন্ন কিছু। তাই তো দীর্ঘ প্রতিক্ষীত কিতাবটি পূর্ণ হওয়ার আগেই আল্লাহ তাআলা হযরতকে আপন দরবারে ডেকে নিলেন।
আহলে হক উলামায়ে কেরামগন হযরত মুফতি সাহেবকে আকাবীরে উলামায়ে দেওবন্দের নীতি ও আদর্শের একজন ভাষ্যকার ও জীবন্ত কিংবদন্তি হিসাবে স্বীকৃতি প্রদান করতেন। তারা বারবার একটি কথাই বলতেন আল্লাহ জানে হযরত মুফতি সাহেবের ইন্তেকালের পর কি হবে, তার মত ব্যক্তিত্ব বর্তমান যুগে দ্বিতীয় আরেকজন চোখে পড়ে না। কোন কোন উলামায়ে কেরাম তো হযরতকে এ শতাব্দীর মুজাদ্দিদ ও মনে করতেন।

মসজিদে গিয়ে জামাতে নামাজ আদায়ের গুরুত্ব:
হযরতুল উসাতায (রহ.) সর্বদা তার মহল্লার মসজিদে গিয়ে জামাতের সাথে নামাজ আদায় করতেন। মসজিদে গিয়ে জামাতে নামাজ আদায়ের প্রতি এতই যত্নবান ছিলেন যে, মারাত্নক অসুস্থতার সময়েও তিনি মসজিদে যাওয়া বাদ দিতেন না।
হযরতের পায়ে সবসময় ব্যথা লেগেই থাকত। মাঝে মধ্যে তা প্রবল আকার ধারণ করত। যখন ব্যথা প্রবল হয়ে যেত তখন শ্বাসকষ্টও বেড়ে যেত। নিঃশ্বাস নিতেও অনেক কষ্ট হত। সেই কঠিন যন্ত্রনার সময়েও হযরত তার সুউচ্চ হিম্মত ও ইমানী শক্তির বলে মসজিদে গিয়েই জামাতে নামাজ আদায় করতেন। যাওয়ার পথে মাঝে মধ্যে হযরতের শ্বাসকষ্ট খুব বেড়ে গেলে সেখানেই বসে পড়তেন। তবুও প্রতি ওয়াক্তে মসজিদে যাওয়ার জন্যে বের হয়ে পড়তেন।
এজাতীয় অবস্থা যখনই দেখা দিত তখন আমি অধম, হযরতের নিকটতম ব্যক্তিবর্গ, দারুল উলূমের আসাতিযা এবং হযরতের যোগ্য সন্তানাদিগন সবাই হযরতকে অনুরোধ করে বলতেন, হযরত! আপনার বর্তমান অবস্থায় মসজিদে গিয়ে নামাজ পড়া তো মোটেও জরুরী নয়, বরং তা আপনার স্বাস্থের জন্য আরো মারাত্নক ঝুকিপূর্ণ। তাই আপনি ঘরেই নামাজ আদায় করুন। তখনও সাধারণত হযরত তা মানতেন না। তবে মাঝে মধ্যে একদম অপারগ হলে মেনে নিতেন। এভাবেই ছিল মসজিদে গিয়ে নামাজের প্রতি হযরতে চুড়ান্ত আগ্রহ।
মৃত্যুর পূর্বের সর্বশেষ দুই বৎসর হযরতের দেহ অনেক ভারী হয়ে গিয়েছিল। তখন প্রায়ই হযরতের শ্বাসকষ্ট বেড়ে যাওয়া এবং পায়ের ব্যথা প্রকট আকার ধারণ করার সাথে সাথে শারীরিক দুর্বলতার কারণেও বাধ্য হয়ে ঘরেই নামাজ আদায় করতে হত। কখনও পাঁচ ওয়াক্ত নামাজই ঘরে আদায় করতে হত। শুধু জুমআর নামাজ কোনমতে মসজিদে গিয়ে আদায় করতেন। তবে এমতাবস্থায়ও বাকী নামাজগুলো ঘরে কাউকে সাথে নিয়ে জামাতের সাথেই আদায় করতেন। অধিকাংশ ক্ষেত্রে আসর ও মাগরিবের নামাজে হযরতের সাথে আমি অধমের থাকার সুযোগ হয়ে যেত। হযরতুল উস্তায হতেন মুকাব্বির আর আমি অধম হতাম হযরতের ইমাম। এটা আমার মত একজন নগন্যের জন্যে অনেক বড় সৌভাগ্যের বিষয় ছিল।

ইলমী একাগ্রতা ও সময়ের পূর্ণাঙ্গ মূল্যায়ন:
হযরতুল উস্তায (রহ.) এত বেশী ইলমী ব্যস্ততায় নিমগ্ন থাকতেন এবং এতো বেশী সময়ের মূল্যায়ন করতেন যে, কোন ব্যক্তির জন্যই হযরতের সাথে ইচ্ছামত সাক্ষাতের কোন সুযোগ ছিলনা। সাধারণত হযরতের সাথে সাক্ষাতের সময় ছিল আসর থেকে মাগরিব পর্যন্ত। ছাত্র হোক বা উস্তায কিংবা মেহমান সকলের জন্যই সাক্ষাতের সময় ছিল এটাই। এমনকি দুর দুরান্ত থেকে আগমনকারী বড় বড় ওলামায়ে কেরামের জন্যও ছিলনা আলাদা কোন সময়। তবে যদি কখনও দারুল উলূমের কোন উস্তায অথবা বড় কোন আলেম গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে পরামর্শের উদ্দেশ্যে সময় চেয়ে নিতেন, তাহলে সেটা ভিন্ন কথা। এব্যাপারেও এ অধমের উপর হযরতুল উস্তাযের যে কি পরিমাণ অনুগ্রহ রয়েছে সেটা আল্লাহ তাওফীক দিলে যখন বিস্তারিত আকারে কিতাব লিখব তখন উল্লেখ করব ইনশাআল্লাহ।
হযরতুল উস্তায আমার মত নগণ্যকে অন্তর থেকেই মুহাব্বাত করতেন। আমাকে তিনি তার ঘরেরই একজন সদস্যের মত মনে করতেন। হযরতের কারণে তার ঘরের সকল সদস্যও আমাকে তাদের অন্তর্ভুক্ত মনে করতেন। আমি অধমও হযরতের পরম স্নেহ ও মমতার কারণে তার ঘরের প্রত্যেকজন সদস্যকে অন্তর থেকে ভালবাসতাম এবং আলহামদুলিল্লাহ এখনও ভালবাসি। আমি যখনই হযরতের খেদমতে উপস্থিত হতাম তখন অত্যান্ত হাসিমুখে হযরত সাক্ষাত প্রদান করতেন এবং সালামের উত্তর দিয়ে জিজ্ঞেস করতেন “কিও ভাই! কেমন আছ? বিশেষ কোন উদ্দেশ্যে এসেছ নাকি এমনিতেই?”
কখনও কখনও হযরতের কক্ষে প্রবেশ করে দেখতাম হযরত মুতালাআ’ বা লেখালেখিতে ব্যস্ত। তখন কোন প্রকার আওয়াজ না করেই আস্তে করে গিয়ে হযরতের সামনে বসে পড়তাম। হযরত মুতালাআ’ বা লেখালেখিতে এ পরিমাণ নিমগ্ন ও ডুবন্ত থাকতেন যে, দশ পনেরো মিনিট পর্যন্ত সময় চলে যেত কিন্তু হযরত ঠেরই পেতেন না তার সামনে কেউ বসে আছে কি না! দশ পনেরো মিনিট অতিক্রান্ত হওয়ার পর হঠাৎ যখন হযরতের দৃষ্টি অধমের উপর পড়ত, তখন বলতেন “কিও ভাই! কেমন আছ? কখন এসেছ?” আমি বলতাম দশ পনেরো মিনিট হল এসেছি। হযরত বলতেন আমি তো ঠেরই পাইনি। আমি তো তোমাকে দেখিইনি। সুবহানাল্লাহ! আল্লাহু আকবার! আল্লাহ তাআলা হযরতকে কি পরিমাণ ইলমি একাগ্রতা দান করেছেন সত্যিই তা ইর্ষণীয় এবং অতুলনীয়।

দারুল উলূম দেওবন্দের শিক্ষকতার ইতিহাসে হযরতুল উস্তায (রহ.) এর অনন্য বৈশিষ্ট:
হযরতুল উস্তায (রহ.) দারুল উলূম দেওবন্দে সুধীর্ঘ আট চল্লিশ বৎসর শিক্ষকতার খেদমত আঞ্জাম দিয়েছেন। এ দীর্ঘ সময়কালে মোটামোটি সর্ব বিষয়েরই প্রচুর কিতাবাদি পড়িয়েছেন। ১৩৯৭ হিজরী থেকে নিয়ে মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত টানা ৪৪ বৎসর দাওরায়ে হাদিসে দারস দিয়েছেন।
দারুল উলূম দেওবন্দ এবং অন্যান্য মাদরাসা সমূহের দাওরায়ে হাদিসে যেসব কিতাবাদি পড়ানো হয় তা হচ্ছে ১. বুখারী শরীফ, ২. মুসলিম শরীফ, ৩. তিরমিযী শরীফ, ৪. আবু দাউদ শরীফ, ৫. নাসাঈ শরীফ, ৬. ইবনে মাযাহ শরীফ, ৭. মুয়াত্তা ইমাম মালিক, ৮. মুয়াত্তা ইমাম মুহাম্মদ, ত্বাহাবী শরীফ এবং ১০. শামাইলে তিরমিযী। অধমের অনুসন্ধানে আলহামদুলিল্লাহ হযরতুল উস্তায (রহ.) দারুল উলূম দেওবন্দে সবকটি কিতাবই পড়িয়েছেন। মাদরে ইলমী দারুল উলূম দেওবন্দের দেড়শত বৎসরের ইতিহাসে শুধুমাত্র হযরত শায়খুল হিন্দ (রহ.) এবং সম্ভবত হযরত আল্লামা কাশ্মীরি (রহ.) দাওরার সকল কিতাব পড়িয়েছেন। উনাদের পরই এ বিরল কৃতিত্ব হযরতুল উস্তায (রহ.) অর্জন করতে পেরেছেন। এটা একমাত্র আল্লাহ তাআলার বিশেষ অনুগ্রহ যা তিনি যাকে ইচ্ছা দান করেন।
কবি বলেন;
ایں سعادت بزور بازو نیست
تانہ بخشد خدائے بخشدہ
এমন সৌভাগ্য দৈহিক শক্তিবলে অর্জিত হয়না।
যতক্ষন না দয়াময় আল্লাহ দান না করেন।

স্বপ্নযোগে হযরতুল উস্তায (রহ.) এর দর্শন লাভ:
হযরতুল উস্তায (রহ.) এর ইন্তেকালের উনিশ দিন পার হয়ে গেছে। এখনও হযরতের ইন্তেকালের শোকে ভগ্নহৃদয় ঠিক হয়নি। আমি এখনও অসুস্থ। সময়ে সময়ে নিজের অজান্তে এখনও কান্নার ঢেউ চলে আসে। হযরতুল উস্তাযের নূরানী চেহারা, গাম্ভীর্যতায় পরিপূর্ণ ব্যক্তিত্ব এবং অন্যান্য গুনাবলী ও অনন্য বৈশিষ্ঠাবলী এখনও আমার চোখের সামনে সর্বদা দৃশ্যমান। এক মুহুর্তের জন্যও চোখ থেকে গায়েব হচ্ছে না।
এরই মধ্যে বিগত ১৫ ই শাওয়াল মোতাবেক ৮ জুন সোমবার দিন ফজরের নামাজের পর যখন মোবাইল অন করলাম, তখন দেখতে পেলাম যে রাত তিনটার দিকে জনাব কাসিম আহমদ ভাইয়ের কাছ থেকে একটি পিডিএফ ফাইল এসেছে, যা হযরতুল উস্তায (রহ.) এর স্মৃতিচারনে দারুল উলূম দেওবন্দের উস্তায জনাব মাওলানা ফাহিম উদ্দিন সাহেব বিজনূরী (হাফিযাহুল্লাহ) লিখেছেন। সাথে সাথে ফাইলটি ডাউনলোড করে শুরু থেকে নিয়ে শেষ পর্যন্ত দুই বার পড়লাম এবং আরেকবার চোখের পানিতে বুক ভাসালাম। প্রবন্ধটি মাশাআল্লাহ অত্যান্ত সমৃদ্ধ বাস্তবসম্মত ও বাড়াবাড়ি মুক্ত ছিল। প্রবন্ধটি পাঠ করার পর মোবাইল বন্ধ করে আবার শুয়ে পড়লাম।
আলহামদুলিল্লাহ ছুম্মা আলহামদুলিল্লাহ ঘুমের মধ্যে দুই দুই বার হযরতুল উস্তাযের দর্শন লাভ করলাম। উভয় স্বপ্নই ছিল প্রায় এক রকমের।
প্রথম বার দেখলাম যে হঠাৎ হযরতুল উস্তায (রহ.) এর ইন্তেকালের সংবাদ প্রচারিত হচ্ছে। এমন সংবাদ পেয়ে আমি নিজেকে আর সামলাতে পারলাম না। সাথে সাথে আমার স্ত্রী সহ দৌড় দিলাম হযরতুল উস্তায (রহ.) এর ঘরের দিকে। যখন ঘরের নিকটে পৌঁছলাম তখন দেখতে পেলাম হযরতের পুরাতন ঘরের মত। হযরত দু-তলায় থাকেন। দু-তলায় উঠতে সিঁড়ির ধাপ দশ থেকে বারোটি হবে। আমি বিলম্ব না করে উপরের দিকে উঠতে শুরু করলাম। উপরে উঠে দেখি হযরতুল উস্তায (রহ.) চেয়ারের উপর বসে আছেন। হযরতের মাথা মুবারক একদম পরিস্কার (মুন্ডানো) দাড়ি মুবারক একদম কালো। দেখতে মনে হল ৩৫ থেকে ৪০ বছরের মধ্যবর্তী একজন টগবগে যুবক। আমি দুই বার সালাম দিলাম কিন্তু কোন উত্তর দিলেন না। তৃতীয় বার অনেক জোরে সালাম করলে হযরত আমার দিকে দৃষ্টি ফেরালেন এবং বললেন “ওয়া আলাইকুমুস সালাম ওয়া রাহমাতুল্লাহ। আসো ভাই আসো” আমি হযরতের নিকটে চলে গেলাম। হযরত হাত দিয়ে ইশারা করে বললেন “আমার মাথা একটু মালিশ করে দাও” আমি হযরতের মাথায় মালিশ করা শুরু করে দিলাম। আমার স্ত্রী হযরতের বাম পা টিপে দিতে লাগল। আরেকজন দারুল উলূমের ফাযিলকে দেখলাম হযরতের ডান পা টিপতে শুরু করল। একবার হযরত ইশারা করে বললেন “মাথার এই এই অংশে হাতের তালু দিয়ে একটু ঘসে দাও” সম্ভবত সেখানে চুলকাচ্ছিল। আমি সে অংশগুলোতে হাতের তালু দিয়ে ঘসতে লাগলাম। কিছুক্ষন পরেই দেখলাম হযরত বললেন “ব্যাস হয়ে গেছে ভাই, হয়ে গেছে” আমরা মালিশ করা ছেড়ে দিলাম। অতপর দেখলাম যেখানে হযরত বসা ছিলেন তার বাম দিকে একটি বারান্দার মত কিছু জায়গা ছিল। হযরতের একজন সাহেবজাদা সম্ভবত জনাব মাওলানা হাসান আহমদ ভাই (হাফিযাহুল্লাহ) অথবা হাফিজ কাসিম আহমদ (হাফিযাহুল্লাহ) এসে হযরতকে বারান্দায় নিয়ে গেলেন এবং আপন উরুর উপর শুইয়ে দিলেন। আমি বারান্দার দিকে আগ্রহের চোখ মেলে তাকিয়ে ছিলাম যে হযরতের দৃষ্টি আমার দিকে পড়লেই যেন তার নিকটে যাওয়ার কথা বলেন। কিন্তু হযরতুল উস্তায (রহ.) এমনভাবে শুয়েছিলেন যে আমার দিকে দৃষ্টি পড়ার সম্ভাবনাই আর বাকি ছিলনা। আমি আর ধৈর্য্য ধরতে পারলাম না। অনুমতি ছাড়াই একদম চলে গেলাম বারান্দায় এবং গিয়ে হযরতের পা টিপতে শুরু করে দিলাম। হযরত আমার দিকে চোখ তুলে তাকালেন। আমি দেখতে পেলাম হযরত যিকির করছেন “সুবহানাল্লাহ, আলহামদুলিল্লাহ, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ” বলে। এক দুই বার “লা হাওলা ওয়া লা কুওয়াতা ইল্লা বিল্লাহ” ও পড়লেন। অতপর দেখলাম হঠাৎ আসমানের দিকে চোখ তুলে তাকিয়ে পড়লেন “লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ” আর সাথে সাথেই হযরতের প্রাণবায়ূ উড়ে গেল। ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন।
ঘড়ির কাটায় সাড়ে আট টা বাজতেই মোবাইলের এলার্ম বেজে উঠল। আমি সাথে সাথে এলার্ম বন্ধ করে আবার শুয়ে পড়লাম। এবারও দেখা গেল আশ্চর্যজনক ভাবে পূর্বের স্বপ্নটাই আবার দেখলাম। এবারও ঠিক আগের মতই হযরতুল উস্তায (রহ.) এর দর্শন লাভ করলাম। পার্থক্য শুধুমাত্র এতটুকু ছিল যে দ্বিতীয় বারের স্বপ্নে আমার সাথে হযরতের জামাতা জনাব মুফতি উসামা সাহেব (হাফিযাহুল্লাহ) ছিলেন। এবং মুফতি উসামা সাহেবই হযরতের বাম পা টিপছিলেন। আমরা উভয়ে যখন হযরতের ঘরের দিকে যাচ্ছিলাম তখন একটি মসজিদের মিনারা নিজে নিজেই জঙ্গলের মত হয়ে গেল। অনেক গাছ পালা এবং কাঁটা বিশিষ্ট ঝাঢ় ঝোপ তৈরী হয়ে গেল। চতুর্দিকে জঙ্গলী প্রণী বিচরণ করছিল। আমাদের জন্যে এমতাবস্থায় সামনে বাড়া কঠিন হয়ে পড়ছিল। তবুও আমরা কোনমতে নিজেদেরকে বাঁচিয়ে হযরতের ঘর পর্যন্ত পৌঁছতে সক্ষম হয়েছিলাম। উভয় স্বপের মধ্যেই দেখেছিলাম যে ছাত্রদের বিশাল বড় জামাত আমাদের পিছনে পিছনে আসছিল এবং তারা ঘরে পৌঁছে শুধু আমাদের দিকেই তাকিয়ে ছিল।
আমি এ স্বপ্নটি বড় বড় দু-তিন জন আলেমকে জিজ্ঞাসা করেছি। তারা আমাকে বললেন যে মাশাআল্লাহ এ স্বপ্নের ব্যাখ্যা অনেক ভাল। এ স্বপ্নদ্বয় ‘মুবাশশিরাত’ তথা আল্লাহর পক্ষ থেকে সুসংবাদ জাতীয় স্বপ্নের অন্তর্ভুক্ত। হযরতুল উস্তায (রহ.) এর অবস্থা সম্পর্কে সুসংবাদ তো এটাই যে জান্নাতের অধিবাসীগন যুবক হবেন এবং উনাদের বয়স চল্লিশ বৎসরের আশেপাশে হবে এবং হযরতুল উস্তায আল্লাহর দয়া ও অনুগ্রহে জান্নাতের প্রাসাদ সমূহেই অবস্থান করছেন। আর আপনার জন্যও সুসংবাদ যে হযরতের সাথে আপনার একনিষ্ট ও অসামান্য মুহাব্বাত ও ভালবাসার কারণে ইন্তেকালের পরও হযরতের রূহের দৃষ্টি আপনার প্রতি নিবদ্ধ রয়েছে।
এ স্বপ্নের পর থেকেই আমার অন্তরে প্রশান্তি আসতে থাকল এবং ধীরে ধীরে আমি শারীরিক ভাবেও সুস্থ হয়ে উঠলাম।
পরিশেষে মহান মালিকের দরবারে কায়মনোবাক্যে ফরিয়াদ জানাই হে আমার মালিক ও মাওলা! আপনি আপনার নবী পাক (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর ওসীলায় আমার প্রাণাধিক প্রিয় উস্তায ও শায়খ হযরতুল উস্তায (রহ.) কে আহলে হক, আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাত এবং পুরা উম্মতে মুসলিমার পক্ষ থেকে উত্তম থেকে উত্তম বদলা দান করুন। হে আল্লাহ! হযরত মুফতি সাহেব (রহ.) এর দারাজাত কে বুলন্দ করুন। হযরতের কবরকে জান্নাতের বাগান বানিয়ে দিন। তার অবস্থান হুজুর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এবং সাহাবায়ে কেরামের নিকটে করে দিন। দিল থেকে দোয়া করি আল্লাহ যেন হযরতুল উস্তায (রহ.) এর সকল সন্তান, আত্নীয় স্বজন, ছাত্র, দারুল উলূম দেওবন্দের পরিচালকগন, উস্তাযগন এবং সকল শুভানুধ্যায়ীকে উত্তম ধৈর্য্য দান করেন এবং মাদরে ইলমী দারুল উলূম দেওবন্দকে সর্ব প্রকার অনিষ্টতা ও ফিতনা ফাসাদ থেকে হেফাজত করেন। আমিন ইয়া রাব্বাল আলামিন।
বক্ষমান প্রবন্ধকে আজ এখানেই ইতি টানছি। ভবিষ্যতে আল্লাহ তাওফীক দান করলে হযরতের স্মৃতিসমূহ নিয়ে একটি স্বতন্ত্র পুস্তক রচনা করব ইনশাআল্লাহ।

লেখক: হেকমতুল্লাহ হানিফ
খাদিম: হযরতুল উস্তায (রহ.)
বর্তমান ঠিকানা: ইরান
তারীখ: ৫ জিলহজ, ১৪৪১ হিজরী, সোমবার

অনুবাদক
বান্দা মুহাম্মদ সায়েম কাসিমি         উস্তায, জামেয়া ইসলামিয়া আরাবিয়া শামীমাবাদ, সিলেট