দ্বীনের সঠিক মাসআলা মানুষের কাছে পৌঁছানোর উদ্দেশ্যে, কুরবানীর মতো গুরুত্বপূর্ণ আমলকে সহীহ পদ্ধতিতে বাস্তবায়নের নেক নিয়তে, সর্বোপরি দ্বীনি দায়িত্ব পালনের তাগিদে আমাদের এই ক্ষুদ্র প্রয়াস। আল্লাহ পাক যেনো ভরপুর কবুল করেন এবং আখেরাতে নাজাতের ওসীলা বানান। আমীন!

কুরবানীর গুরুত্ব

কুরবানী ইসলামের গুরুত্বপূর্ণ একটি ইবাদত। আল্লাহর সঙ্গে বান্দার ভালোবাসার অনন্য প্রতীক। কুরবানীর মাধ্যমেই আল্লাহর নির্দেশ পালন ও ভালোবাসার পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছিলেন মুসলিম জাতির পিতা হযরত ইব্রাহীম আ.। কুরবানী করা আল্লাহর স্বতন্ত্র একটি নির্দেশ। যেমন: কুরআনে আল্লাহ তায়ালা বলেন:  ﴾فصل لربك وانحر ﴿
“আপন পালন কর্তার উদ্দেশ্যে (ঈদের) নামায পড়ো এবং কুরবানী করো” (সূরা কাওসার-২)
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিয়মিত কুরবানী করেছেন। হাদীস শরীফে বর্ণিত হয়েছে,
( أقام رسول الله ﷺ بالمدينة عشر سنين يضحي )
অর্থাৎ ইবনে ওমর থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন: “রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মদীনায় দশ বছর অবস্থান করে (দশ বছরই) কুরবানী করেছেন”। (তিরমিযী, হাদীস নং: ১৫০৭)
উক্ত আয়াত ও হাদীসের দ্বারা বোঝা গেলো কুরবানীর খুব গুরুত্ব ও তাৎপর্য রয়েছে।

কুরবানীর ফযীলত

হযরত আলী রা. বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ফাতেমা রাযি. কে তার কুরবানীর নিকট উপস্থিত থাকতে বললেন এবং ইরশাদ করলেন, এই কুরবানীর প্রথম রক্তবিন্দু প্রবাহিত হওয়ার সাথে সাথেই আল্লাহ তাআলা তোমার গুনাহসমূহ মাফ করে দিবেন। তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, এটা কি শুধু আহলে বাইতের জন্য? না সকল মুসলমানের জন্য? তিনি বললেন, এই ফযীলত সকল মুসলমানের জন্য। (মাজমাউয যাওয়াইদ, ৪/১৭, আততারগীব ওয়াততারহীব, ১/১৭৫)

কুরবানী না করার ভয়াবহতা

কুরবানী এমন একটি ইবাদত যা বছরে মাত্র একবারই আসে। সময় চলে গেলে কুরবানী করা সম্ভব হয় না। কুরবানী না করার ভয়াবহতা সম্পর্কে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
“من كان له سعة ولم يضح؛ فلا يقربنّ مصلانا”
“যে ব্যক্তি কুরবানী করার সামর্থ থাকার পরও কুরবানী করল না; সে যেনো ঈদগাহে না আসে”। (ইবনে মাজাহ, হাদীস নং: ৩১২৪) সামর্থ থাকার পরও যে কুরবানী করবে না, সে আল্লাহ ও রাসূল সা. এর অসন্তুষ্টি লাভ করবে। কুরবানী না করার শাস্তি অনেক ভয়াবহ হবে।

কুরবানীর নেসাব

স্বর্ণের ক্ষেত্রে সাড়ে সাত (৭.৫) ভরি। আর রুপার ক্ষেত্রে সাড়ে বায়ান্ন (৫২.৫) ভরি। আর অন্যান্য বস্তুর ক্ষেত্রে সাড়ে বায়ান্ন ভরি রুপার সমমূল্যের সম্পদ। স্বর্ণ বা রুপার কোনো একটি যদি পৃথকভাবে নেসাব পরিমাণ না হয়, তবে স্বর্ণ-রুপা উভয়টি মিলে কিংবা এর সাথে প্রয়োজন-অতিরিক্ত অন্য বস্তুর মূল্য মিলে সাড়ে বায়ান্ন ভরি রুপার সমমূল্যের হয়ে যায় সেক্ষেত্রেও কুরবানী ওয়াজিব হবে।
স্বর্ণ-রুপার অলঙ্কার, নগদ অর্থ, যে জমি বাৎসরিক খোরাকীর জন্য প্রয়োজন হয় না এবং প্রয়োজন অতিরিক্ত আসবাবপত্র; এ সবই কুরবানীর নেসাবের ক্ষেত্রে হিসাবযোগ্য। (বাদায়েউস সানায়ে ৪/১৯৬,আলমুহীতুল বুরহানী ৮/৪৫৫; ফাতাওয়া তাতারখানিয়া ১৭/৪০৫)

যাদের উপর কুরবানী ওয়াজিব

প্রাপ্তবয়ষ্ক, সুস্থ মস্তিষ্কসম্পন্ন প্রত্যেক মুসলমান নর-নারী; মুকীম ব্যক্তি, যে ১০ যিলহজ্ব সুবহে সাদিক থেকে ১২ যিলহজ্ব সূর্যাস্ত পর্যন্ত সময়ের মধ্যে প্রয়োজন অতিরিক্ত নেসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক হবে তার উপর কুরবানী করা ওয়াজিব হবে। (আহকামুল কুরআন, জাসসাস ৩/১২৮)

ঋণ থাকলেই কি কুরবানী মাফ হয়ে যাবে?

নেসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক যদি কুরবানীর দিনগুলোতে সাময়িক ঋণগ্রস্ত থাকে, যা পরিশোধ করে দিলে তার কাছে প্রয়োজনের অতিরিক্ত নেসাব পরিমাণ সম্পদ বাকি থাকে না; তাহলে তার উপর কুরবানী ওয়াজিব হবে না। আর যদি ঋণ আদায় করে দিলেও নেসাব পরিমাণ সম্পদ বাকি থাকে; তাহলে তার উপর কুরবানী ওয়াজিব হবে। তাই ঋণ থাকলেই কুরবানী মাফ, এমন ধারণা ঠিক নয়। (বাদায়েউস সানায়ে ৪/১৯৬; ফাতাওয়া হিন্দিয়া ৫/২৯২)

যৌথ ফ্যামিলির কুরবানী

একাধিক ব্যক্তি বা পরিবারের সকল সদস্যের পক্ষ থেকে একটি ছাগল কুরবানী দিলে তা যথেষ্ট হবে না। বরং যৌথ সম্পত্তি (যার মালিকানা যৌথভাবে সকলের, যেমন বাবা মারা যাওয়ার পর অবশিষ্ট অবণ্ঠিত সম্পত্তি) যদি এ পরিমাণ হয় যে, বণ্টন করলে প্রত্যেক সদস্য প্রয়োজন অতিরিক্ত নেসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক হয়ে যায়; তাহলে প্রত্যেকের উপর পৃথক পৃথক কুরবানী করা ওয়াজিব হবে। অবশ্য কেউ নেসাব থেকে কম সম্পদের মালিক হলে তার উপর কুরবানী ওয়াজিব হবে না। তদ্রুপ কেউ অপ্রাপ্ত বয়স্ক হলে তার উপরও কুরবানী ওয়াজিব নয়। (মুসতাদরাকে হাকেম, হাদীস : ৭৬৩৯; ফাতাওয়া হিন্দিয়া ১/১৮১; ফাতাওয়া তাতারখানিয়া ৩/২৪২; আদ্দুররুল মুখতার ৬/৩১৬; তাবয়ীনুল হাকায়েক ৬/৪৭৫)

জমা টাকা নেসাব পরিমাণ হলে কুরবানী করতে হবে

ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে যেমন মেয়ে বিবাহ দেওয়া, ঘর-বাড়ি বানানো, বিদেশ যাওয়া ইত্যাদির জন্য বিভিন্ন বীমা ও ইন্সুরেন্স কোম্পানিতে বা নিজের কাছে নিত্যপ্রয়োজনের অতিরিক্ত নিসাব পরিমাণ টাকা জমা থাকলে কুরবানী ওয়াজিব হবে। জমা টাকা নেসাব পরিমাণ হলে তা যে উদ্দেশ্যেই রাখা হোক; তার উপর কুরবানী ওয়াজিব হবে। একটি ছাগল দ্বারা হলেও তা আদায় করতে হবে। উল্লেখ্য, প্রচলিত বীমা কোম্পানিগুলো লেনদেন সুদ ও জুয়ার উপর প্রতিষ্ঠিত। তাই এতে অংশগ্রহণ না করা কর্তব্য। (মাবসূত সারাখসী ২/১৮৯; আলমুহীতুল বুরহানী ৩/১৫৬, ৮/৪৫৫; বাদায়েউস সানায়ে ৪/১৯৬; আদ্দুররুল মুখতার ২/২৫৯, ৬/৩১২)

অবৈধ সম্পদের কুরবানী নেই

অবৈধ সম্পদ ও হারাম টাকা নেসাবের অন্তর্ভুক্ত হয় না এবং সে টাকার উপর কুরবানীও ওয়াজিব হয় না। বরং হারাম টাকা পুরোটাই সওয়াবের নিয়ত ছাড়া সদকা করতে হবে। (ফাতাওয়া তাতারখানিয়া ৩/২৩৩; আলবাহরুর রায়েক ২/২০৫; রদ্দুল মুহতার ২/২৯১; আততাকরীরুল মুখতার, রাফেয়ী ২/১৩৩)

কুরবানীর গোশত দিয়ে খাবার শুরু করা

কুরবানীর দিন কুরবানীর গোশত দিয়ে খাবার শুরু করা মুস্তাহাব। তাই এর আগ পর্যন্ত যথাসম্ভব খানাপিনা থেকে বিরত থাকা উত্তম। হযরত বুরাইদা রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, ঈদুল আযহার দিন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কুরবানীর গোশত খাওয়ার আগ পর্যন্ত অন্য কিছু খেতেন না। এই আমল করতে পারলে সওয়াব হবে। না পারলে কোনো অসুবিধে নেই। (সুনানে দারাকুতনী ২/৪৫; মুসতাদরাকে হাকেম, হাদীস ১১২৭; মুসনাদে আহমদ, হাদীস ২২৯৮৪; বাদায়েউস সানায়ে ১/৩২৪; আলবাহরুর রায়েক ২/১৬৩)

হাঁস, মুরগীর কুরবানী

কুরবানীর দিনে কুরবানীর নিয়ত না করে কেবল খাওয়ার উদ্দেশ্যে হাঁস, মুরগী ইত্যাদি যবাই করা জায়েয। এতে দোষের কিছু নেই। তবে কুরবানীর নিয়তে কিংবা কুরবানীর সাদৃশ্য অবলম্বনের উদ্দেশ্যে হাঁস, মুরগী যবাই করা যাবে না। (“যার বড় প্রাণী কুরবানী করার সামর্থ নাই; সে ছোট- প্রাণী হাঁস, মুরগী ইত্যাদি কুরবানী করবে” এমন কথা ঠিক নয়)। (ফাতাওয়া হিন্দিয়া ৫/৩০০; ফাতাওয়া বাযযাযিয়া ৩/২৯০; আদ্দুররুল মুখতার ৬/৩১৩; হাশিয়াতুত্ তহতাবী আলাদ্দুর ৪/১৬০)

কুরবানীর পশুর নাড়ি-ভুঁড়ি বিনিময় হিসেবে দেওয়া যাবে না

যে মহিলা দ্বারা কুরবানীর পশুর নাড়ি-ভুঁড়ি (ভঁড়ল) পরিস্কার করা হয়, সেই মহিলাকে পারিশ্রমিক হিসেবে ভুঁড়ির অংশবিশেষও দেওয়া যাবে না। বরং তাকে এই কাজের জন্য আলাদাভাবে পারিশ্রমিক দিতে হবে। কেননা বিনিময় হিসেবে গোশত বা ভুঁড়ির কোনো অংশ দেওয়া জায়েয নয়। বিগত বছরগুলোতে এমন করে থাকলে যে পরিমাণ অংশ পারিশ্রমিক হিসেবে দেওয়া হয়েছে তার ন্যায্যমূল্য সদকা করে দিতে হবে। তবে কথা-বার্তা বা চুক্তির সময় গোশত বা ভুঁড়ি দেওয়ার শর্ত না থাকলে ন্যায্য পারিশ্রমিক দেওয়ার পর কুরবানীর পশুর ভুড়ি বা গোশত হাদিয়া হিসেবে দেওয়া যাবে। এতে কোনো অসুবিধা নেই। (সহীহ মুসলিম ৩/৩৫০; সহীহ বুখারী, ফাতহুল বারী ৩/৬৫০, আদ্দুররুল মুখতার ৬/৩২৮; ফাতাওয়া খানিয়া ৩/৩৫৪; আলবাহরুর রায়েক ৮/১৭৮; আলমাবসূত, সারাখসী ১২/১৪; ইলাউস সুনান ১৭/২৬৩)

পশুকে শোয়ানোর তরীকা

পশু যবাইয়ের সময় পশুর মাথা দক্ষিণ দিকে এবং সীনা কিবলামুখী করবে। এতে পশুর পা পশ্চিম দিকে থাকবে। এভাবে শোয়ানো উত্তম। হাদীস শরীফে আছে, জাবির রা. বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কুরবানীর দিন হৃষ্টপুষ্ট শিং বিশিষ্ট দুটি ভেড়া যবাই করেছেন। তিনি ভেড়া দুটির সীনা কিবলামুখী করে শুইয়ে দিলেন এবং বিসমিল্লাহি আল্লাহু আকবার বলে যবাই করলেন। (সুনানে আবু দাউদ, হাদীস: ২৭৮৮; বাযলুল মাজহূদ ১৩/১৬, উমদাতুল কারী ২১/১৫৭; ফাতহুল বারী ১০/২১;)
সহীহ মুসলিমের ভাষ্যগ্রন্থ আলমিনহাজে ইমাম নববী রাহ. বলেন, এ ব্যাপারে আলেমগণ একমত এবং মুসলমানদের আমলও এভাবে চলে আসছে যে, যবাইয়ের সময় পশুকে বাম পার্শ্বদেশের উপর শোয়াবে। কেননা এ পদ্ধতিতে যবাইকারীর জন্য ডান হাতে ছুরি নেওয়া এবং বাম হাত দিয়ে পশুর মাথা চেপে ধরে যবাই করা অধিকতর সহজ। তাই ইচ্ছাকৃত এর ব্যতিক্রম করা উচিত নয়। ভুলবশত বা বেখেয়ালে হয়ে গেলে অসুবিধা নেই। (বাদায়েউস সানায়ে ৪/২১১, শরহে মুসলিম, নববী ১৩/১২২)

কসাইকে কি গোশত দেওয়া যাবে?

কসাই এবং যে গোশত কাটে, বা যারা এ কাজে সহযোগিতা করে, তাদের কাউকেই কুরবানীর পশুর কোনো কিছু পারিশ্রমিক হিসেবে দেওয়া জায়েয নেই।
এক্ষেত্রে করণীয় হলো, কসাইয়ের সাথে কাজের বিনিময়ে টাকা বা অন্য কিছু দেওয়ার চুক্তি করবে। কুরবানীর পশুর কোনো অংশ দেওয়ার চুক্তি করবে না। হ্যাঁ, চুক্তি অনুযায়ী পূর্ণ পারিশ্রমিক দেওয়ার পর অন্যান্য আত্মীয়-স্বজন বা গরীবদের যেমনিভাবে কুরবানীর গোশত বা চামড়া দেওয়া হয় তেমনি কোনো রূপ চুক্তি ব্যতিত কসাইকেও হাদিয়া হিসেবে কুরবানীর চামড়া বা গোশত দেওয়া যাবে। শর্ত বা চুক্তি করে কুরবানীর কোনো অংশ দেওয়া যাবে না। বিগত বছরগুলোতে এমন করে থাকলে যে পরিমাণ অংশ পারিশ্রমিক হিসেবে দেওয়া হয়েছে তার ন্যায্যমূল্য সদকা করে দিতে হবে। হযরত আলী রা. বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাকে উট নহর করতে আদেশ করেছেন এবং কসাইকে (পারিশ্রমিক হিসেবে) কুরবানীর পশুর কোনো কিছু দিতে নিষেধ করেছেন।আলী রা. বলেন, আমরা তাদেরকে নিজেদের অংশ থেকে (এমনিই) দিয়ে থাকি (পারিশ্রমিক হিসেবে নয়)। (সহীহ বুখারী ১/২৩২; সহীহ মুসলিম ১/৪২৩; আলমুহীতুল বুরহানী ৮/৪৭০; রদ্দুল মুহতার ৬/৩২৮)

কুরবানীর পশুর কোনো কিছু কি বিক্রি করা যাবে?

নিজের কুরবানীর পশুর গোশত, ভুঁড়ি, চর্বি, হাড্ডি কিছুই বিক্রি করা জায়েয নেই। এতে কুরবানী ক্রটিযুক্ত হয়ে যায়। বিগত দিনে নিজেদের কুরবানীর পশুর গোশত, চর্বি, ভুড়ি বিক্রি করে যত টাকা পেয়েছেন তা গরীবদেরকে সদকা করে দিতে হবে। ভুঁড়ি, চর্বি নিজেরা খেতে না পারলে সরাসরি গরীবদেরকে দান করে দিবে, বিক্রি করবে না। অবশ্য কাউকে দেওয়ার সুযোগ না থাকার কারণে তা নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা হলে বিক্রি করা যাবে। অতপর প্রাপ্ত অর্থ সদকা করে দিতে হবে। আর চামড়া বিক্রি করলে তার পূর্ণ টাকা সদকা করতে হবে। (বাদায়েউস সানায়ে ৪/২২৫; ফাতাওয়া হিন্দিয়া ৫/৩০১; আদ্দুররুল মুখতার ৬/৩২৮) মুসনাদে আহমদ, হাদীস ১৬২১১; মাজমাউয যাওয়াইদ, ৪/২৭;, শরহু মুখতাসারিত তাহাবী ৭/৩৩৯, আলখানিয়া ৩/৩৫৪ খুলাসাতুল ফাতাওয়া ৪/৩২২

আকীকার গোশত কীভাবে বণ্টন করা হবে?

আকীকার গোশত বণ্টনের হুকুম কুরবানীর মতোই। আয়েশা রা. থেকে বর্ণিত আকীকা সংক্রান্ত একটি দীর্ঘ হাদীসে এসেছে, … (আকীকার গোশত থেকে) নিজে খাবে, অন্যকে খাওয়াবে এবং সদকা করবে। (মুসতাদরাকে হাকেম, হাদীস ৭৬৬৯) তাই কুরবানী ও আকীকা একই ব্যক্তির হলে গোশত পৃথক করার প্রয়োজন নেই; বরং চাইলে উভয় গোশত একত্রে মিলিয়ে তিনভাগে বণ্টন করতে পারবে। এক অংশ নিজের জন্য, আরেক অংশ গরীব মিসকীনদের জন্য, তৃতীয় অংশ আত্মীয়-স্বজনদের জন্য। প্রয়োজন হলে পুরোটাই নিজের জন্যও রাখতে পারবে। তবে বণ্টন করলে সওয়াব বেশি হবে। (সহীহ মুসলিম, হাদীস: ১৯৭২; মুয়াত্তা, ইমাম মুহাম্মাদ পৃ. ২৮১-২৮২; হিদায়া ৪/৪৫০; উমদাতুল কারী ১০/৫৭-৫৮; বাদায়েউস সানায়ে ৪/২২৪; আলবাহরুর রায়েক ৮/১৭৮; ফাতাওয়া হিন্দিয়া ৫/৩০০; আদ্দুররুল মুখতার ৬/৩২৭-৩২৮, ইলাউস সুনান ১৭/১১৮, ১৭/১২৬; রদ্দুল মুহতার ৬/৩১৭; আলমুগনী ইবনে কুদামা ১৩/৩৯৩)

হিন্দুকে কুরবানির গোশত দেওয়া যাবে?

কুরবানীর গোশত হিন্দু বা অমুসলিমকেও দেওয়া জায়েয। এতে অসুবিধার কিছু নেই। হাসান বসরী রাহ. ও ফকীহ ইবরাহীম ইবনে খালেদ আবু ছাওর রাহ. বিধর্মীকে কুরবানীর গোশত দেওয়া জায়েয বলেছেন। (ফিকহুল ইমাম আবু ছাওর ৪০২; ফাতাওয়া হিন্দিয়া ৫/৩০০, আলমুহীতুল বুরহানী ৮/৪৬৯; ফাতাওয়া তাতারখানিয়া ১৭/৪৩৭; ইমদাদুল আহকাম ৪/২০৬)

কুরবানীর কাযা/ কুরবানী না করলে করণীয়

কোনো ব্যক্তির উপর কুরবানী ওয়াজিব হওয়া সত্ত্বেও যদি সে কুরবানীর পশু ক্রয় না করে এবং কুরবানীও না করে থাকে; তাহলে যে কয় বছর কুরবানী করা হয়নি প্রত্যেক বছরের জন্য অন্তত এক বছর বয়সী একটি ছাগলের মূল্য সদকা করতে হবে। এক্ষেত্রে গরুর সপ্তমাংশের হিসাব যথাযথ নয়। তবে হাঁ, গরুর সপ্তমাংশের মূল্য যদি এক বছর বয়সী ছাগলের মূল্য সমপরিমাণ বা বেশি হয়; তাহলে সেক্ষেত্রে তা সদকা করলে কাযা আদায় হবে। কিন্তু এক বছর বয়সী ছাগলের মূল্যের কম হলে আদায় হবে না। আর যথাসময়ে কুরবানী না করার কারণে তাওবা-ইস্তিগফার করবে। (ফাতাওয়া তাতারখানিয়া ১৭/৪২৩; রদ্দুল মুহতার ৬/৩২১; তুহফাতুল ফুকাহা ৩/৮৩; বাদায়েউস সানায়ে ৪/২০২, ২০৩ আল-মাবসূত, সারাখসী ১২/১৪; খুলাসাতুল ফাতাওয়া ৪/৩১১; ফাতাওয়া হিন্দিয়া ৫/২৯৬)

হাসিল না দিলে কুরবানী কি জায়েয হবে?

পশুর হাট থেকে কুরবানীর জন্তু ক্রয় করলে প্রত্যেক পশু কেনার পর হাসিল দিতে হয়। ইহাকে কোনো এলাকায় জমা, বা ইজারা/ রশিদ মূল্য বলে। হাসিল হাটের ভাড়া। হাটের ট্যাক্স। এটি হাট কর্তৃপক্ষের হক। যা হাটের সুবিধা গ্রহণের বিনিময়ে নেওয়া হয়। তাই এ টাকা পরিশোধ করা জরুরি। হাসিল না দিলে হাট কর্তৃপক্ষের হক নষ্ট করার গুনাহ হবে। তাই কেউ হাসিল না দিয়ে থাকলে হাট কর্তৃপক্ষের নিকট তা পৌঁছে দিতে হবে। অবশ্য হাসিল না দেওয়ার কারণে কুরবানী নাজায়েয হয়ে যাবে না। কুরবানী সহীহ হবে। তবে এধরণের কাজ থেকে বিরত থাকতে হবে। (আল-কাউসার প্রশ্ন নং ৩৩৪৪)

কুরবানীর পশু চুরি বা মারা গেলে কী করণীয়?

কুরবানীর পশু ক্রয় করার পর, যবাই করার আগে যদি মারা যায় অথবা চুরি হয়ে যায় আর কুরবানীদাতা ধনী হয়ে থাকে অর্থাৎ তার কাছে কুরবানীর দিনসমূহে প্রয়োজন অতিরিক্ত নেসাব পরিমাণ সম্পদ থাকে তাহলে তাকে আরেকটি পশু খরিদ করে কুরবানী করতে হবে। সেক্ষেত্রে একটি ছাগল কুরবানী দিলেও চলবে। আর যদি সে গরীব হয় অর্থাৎ তার কাছে কুরবানীর দিনসমূহে প্রয়োজন অতিরিক্ত নেসাব পরিমাণ সম্পদ না থাকে তাহলে তাকে নতুন করে কুরবানী করতে হবে না। (কিতাবুল আছল ৫/৪১০; শরহু মুখতাছারিত তাহাবী ৭/৩৬১; সুনানে কুবরা বায়হাকী ৯/২৮৯; মাজমাউল আনহুর ৪/১৭৩; বাদায়েউস সানায়ে ৪/১৯৯; ফাতাওয়া খানিয়া ৩/৩৪৭; আলমুহীতুল বুরহানী ৮/৪৫৯; ফাতাওয়া হিন্দিয়া ৫/২৯৯; আদ্দুররুল মুখতার ৬/৩২৫, তাবয়ীনুল হাকায়েক ৬/৪৮২; রদ্দুল মুহতার ৬/৩১২)

দান-খায়রাত কুরবানীর বিকল্প হতে পারে না

সদকা-খায়রাত বছরের যে কোনো সময় করা যায়। তাছাড়া একটি আমল আরেকটি আমলের বিকল্প হয় না। যেমন নামায পড়লে রোযা আদায় হয় না; বরং আলাদাভাবে রোযা রাখতে হয়, তেমনিভাবে দান-খয়রাত একটি আমল আর কুরবানী হলো আরেকটি পৃথক আমল। তাই দান-খায়রাত অতি উত্তম হলেও তা কুরবানীর বিকল্প হবে না। কেননা দান-খায়রাত কুরবানীর সমকক্ষ ও বিকল্প নয়। সুতরাং যারা সামর্থবান তাদেরকে অবশ্যই কুরবানী করতে হবে। (বুখারী ১/১৩২, হিন্দিয়া ৫/২৯৩, বাদায়েউস্ সানায়ে ৪/২০০, ই’লাউস্ সুনান ১৭/২২২, ফতহুল মুলহিম ৩/৫৪৯)

পশু ঠাণ্ডা হওয়ার আগে ছিলানো ঠিক নয়

জবাই করার সময় পশুকে কষ্ট দেওয়া যাবে না। অনেকে যবাইয়ের পর পশু ঠাণ্ডা হওয়ার পূর্বেই চামড়া ছিলার কাজ শুরু করে দেয়, যা মাকরূহ। ঠাণ্ডা হওয়ার আগে পায়ের রগগুলো কেটে দেয়া ও তাড়াতাড়ি দম বের হওয়ার জন্য গলায় ছুরি দিয়ে আঘাত করা উচিত নয়। এ থেকে বিরত থাকা জরুরি। হযরত শাদ্দাদ ইবনে আওস রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন: إِنّ اللهَ كَتَبَ الْإِحْسَانَ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ، فَإِذَا قَتَلْتُمْ فَأَحْسِنُوا الْقِتْلَةَ، وَإِذَا ذَبَحْتُمْ فَأَحْسِنُوا الذّبْحَ، وَلْيُحِدّ أَحَدُكُمْ شَفْرَتَهُ، فَلْيُرِحْ ذَبِيحَتَهُ
“আল্লাহ তাআলা সকল কিছুর উপর অনুগ্রহকে অপরিহার্য করেছেন। এতএব, যখন তোমরা (কাউকে শরীয়ত মুতাবেক হদ বা কিসাস হিসাবে) হত্যা করবে তো উত্তম পদ্ধতিতে হত্যা কর, যখন যবেহ করবে তো উত্তম পদ্ধতিতে যবেহ কর। এবং প্রত্যেকে তার ছুরিতে শান দিবে, যেন জবাইয়ের প্রাণির বেশি কষ্ট না হয়”। (সহীহ মুসলিম, হাদীস ১৯৫৫; আবু দাউদ, হাদীস ২৮১৫; জামে তিরমিযী, হাদীস ১৪০৯; সুনানে নাসায়ী, হাদীস ৪৪০৫, আদ্দুররুল মুখতার ৯/৪২৭, ফাতাওয়া তাতারখানিয়া ১৭/৩৯৭, )

কুরবানীর পশু নিজ হাতে জবাই করা উত্তম

যে ব্যক্তি নিজে পশু যবাই করতে জানে তার জন্য মুস্তাহাব হলো নিজের কোরবানির পশু নিজেই যবাই করা। এটাই সব কিতাবে পাওয়া যায়। হ্যাঁ, তবে যদি নিজে যবাই করতে জানে না বা জানে; তবে ভালো করে জানে না, তাহলে অন্য কাউকে দিয়ে যবেহ করানোর অনুমতি আছে। তবে ইমাম সাহেব বা মাওলানা সাহেব/ যে কোনো হুযূরকে দিয়ে যবেহ করানো জরুরী মনে করা ঠিক নয়, শরীয়তের মধ্যে এর কোন আসল বা ভিত্তি নেই। আনাস ইবনে মালিক রা. বলেন-
. ضَحّى النّبِيّ صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلّمَ بِكَبْشَيْنِ أَمْلَحَيْنِ، فَرَأَيْتُهُ وَاضِعًا قَدَمَهُ عَلَى صِفَاحِهِمَا، يُسَمِّي وَيُكَبِّرُ، فَذَبَحَهُمَا بِيَدِهِ
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দুটি সাদা-কালো বর্ণের নর দুম্বা কুরবানী করেছেন। এবং বিসমিল্লাহি আল্লাহু আকবার বলেছেন। আর আমি দেখেছি যে, তিনি দুম্বা দুটির গর্দানে পা রেখে নিজ হাতে সেগুলো জবাই করেছেন। (সহীহ বুখারী, হাদীস ৫৫৫৮; সহীহ মুসলিম, হাদীস ১৯৬৬; সুনানে নাসায়ী, হাদীস ৪৩৮৭, ফাতাওয়া শামী ৯/৪৭৪)

যে কারণে অধিকাংশ লোকের কুরবানী কবুল হয়না

সমাজের অসংখ্য মানুষের কুরবানী নিয়তে গড়মিল থাকার কারণে আল্লাহর নিকট কবুল হয়না। অনেকে সামাজিক মর্যাদার দিকে লক্ষ্য করে এইভেবে কুরবানী করে যে, কুরবানী না করলে সমাজের মানুষ কি বলবে! কুরবানি না দিলে সন্তানরা অন্যের দিকে চেয়ে থাকবে, কেউবা কেবল গোশত খাওয়ার উদ্দেশ্যে, অথবা খ্যাতি অর্জনের উদ্দেশ্যে বড় পশু কুরবানী করে। আল্লাহর নিকট এদের কারোরই কুরবানী কবুল হবেনা। আল্লাহ তা’আলা বলেন, “এগুলোর (কুরবানীর পশুর) গোশত ও রক্ত আল্লাহর নিকট পৌঁছে না, বরং তাঁর নিকট পৌঁছে তোমাদের অন্তরের তাকওয়া”। (সুরা হজ: আয়াত ৩৭)
অতএব, কুরবানি করতে হবে কেবল আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের লক্ষ্যে। (কিতাবুল মাসাইল: ২/২৯৯)।

সংকলনে: মুফতী জামিল মাসরূর

শিক্ষক, জামেয়া ইসলামিয়া আরাবিয়া শামীমাবাদ

কুরবানীর জরূরী মাসাঈল বইটি ডাউনলোড করতে DOWNLOAD বাটনে ক্লিক করুন