بسم الله الرحمن الرحيم

!نحمده ونصلي على رسوله الكريم ، أما بعد

ভূমিকা

শিক্ষা জাতির মেরুদণ্ড, উন্নতির সোপান। সুশীল সমাজ বিনির্মাণের চাবিকাঠি, সুন্দর সমাজ গড়ার পূর্বশর্ত, সকল প্রকার অসভ্যতা দূর করার হাতিয়ার। তবে নিঃসন্দেহে তা মানব রচিত কোন শিক্ষাব্যবস্থা নয়, বরং একমাত্র খোদাপ্রদত্ত কুরআন-সুন্নাহর সহীহ তালীমই হচ্ছে মানুষের ইহকালীন ও পরকালীন সফলতার অন্যতম সহায়ক। যে তা’লীম পবিত্র মক্কা নগরীর হেরা গুহা থেকে সূচনা হয়ে তার স্নিগ্ধ জ্যোতি বিকিরণে গোটা মানবমণ্ডলীকে মুগ্ধ করেছিল। বিশ্বধরণীকে উপহার দিয়েছিলো সর্বযুগের শ্রেষ্ঠ সভ্যতা। যা স্বয়ং আল্লাহপাক হযরত জিব্রাইল আ. এর মাধ্যমে প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ সা. কে শিক্ষা দিয়েছিলেন। পরবর্তীতে রাসূল সা. শিক্ষকরূপে মুসলিমদেরকে পবিত্র কুরআনের বাণী শিক্ষা দিতে শুরু করলেন। এ মর্মে তিনি ঘোষণা করলেন, ‘আমাকে শিক্ষক হিসেবে প্রেরণ করা হয়েছে’। রাসূল সা. তার মক্কী জীবনে অত্যন্ত প্রতিকূল পরিবেশেও প্রায় ১৩টি কেন্দ্রে ইসলামী শিক্ষাব্যবস্থা চালু রেখেছিলেন। হিজরত করে মদিনায় আসার পর মসজিদে নববীর ‘সূফফা’ নামক স্থান থেকে ইসলামী শিক্ষার স্রোতধারাকে আরো বেগবান করে তোলেন।

খোলাফায়ে রাশেদীন তথা ইসলামের স্বর্ণালী যুগের সূচনালগ্ন থেকে তুর্কি খেলাফতের শেষ আমল পর্যন্ত গোটা মুসলিম বিশ্বে ইসলামী শিক্ষাই ছিল একমাত্র শিক্ষাব্যবস্থা এবং ইসলামী শিক্ষায় শিক্ষিতরাই ছিল সমাজে সর্বজন স্বীকৃত, গুণী ও আদর্শবান।

১৩০০ ঈসায়ি সনের শুরুর দিকে সুলতান কুতুবুদ্দীন আইবেকের শাসনামলে ভারত উপমহাদেশে প্রচলিত ক্বওমি মাদরাসা শিক্ষার সূচনা হয়। মুলতানের গভর্ণর নাসিরুদ্দীন কুবাচাহ মুলতানের ‘উচ্ছ’ নামক স্থানে ‘মাদরাসায়ে ফিরোজি’ নামে একটি ক্বওমী মাদরাসা স্থাপন করেন। পরবর্তীকালে সমগ্র ভারতবর্ষে বিভিন্ন স্থানে অসংখ্য অগণিত ক্বওমী মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করা হয়।

বাংলাদেশে ইলমে হাদীসের সূচনা:
ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, বাংলাদেশে ইলমে হাদীসের সূচনা হয়, বীর সেনানী ইখতিয়ার উদ্দীন মুহাম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজী রহ.-এর নেতৃত্বে বঙ্গ বিজয়ের পূর্বেই। ছয়শত হিজরীর সূচনালগ্নে একদল সাধকের আগমন ঘটে। সেসব আগন্তুকদের মধ্যে অন্যতম হলেন: শাহজালাল তিবরিজী (মৃত্যু ৬৪২ হিজরী), শায়খ শরফুদ্দীন আবু তাওয়ামা, শায়খ আলাউল হক, শায়খ নূর কুতুব, শায়খ শাহজালাল ইয়ামনী (যিনি সিলেটে সমাহিত হন), শায়খ আহমদ তাননূরী, শায়খ বদরুদ্দীন, শায়খ মুহাম্মদ ইবনে ইয়াজদানে বখশ, শায়খ ফরীদ ও শায়খ মুমীনুল্লাহ রহ. সহ আরো অনেক মুহাদ্দিসীন ও সূফিয়ায়ে কেরাম।
মূলতঃ তাদের আগমনের পর থেকে এদেশে ব্যাপকভাবে ইসলামের প্রচার-প্রসার শুরু হয় এবং এ লক্ষ্যে বহু মনীষীর একের পর এক আগমন ঘটে এ মাটিতে। তারা একদিকে যেমন নিজেদের মধুর ব্যবহার ও ইসলামের অমীয় বাণী প্রচার করে জনগণের হৃদয় জয় করতে থাকেন। অপরদিকে তারা ধর্মীয় শিক্ষা-দীক্ষার জন্য প্রতিষ্ঠা করেন বিভিন্ন দ্বীনি শিক্ষালয়, মক্তব ও খানকাহ। ক্রমেই সেগুলো হয়ে ওঠে কুরআন ও হাদিস সম্পর্কে সঠিক জ্ঞান লাভ ও ইসলামের কেন্দ্রে। এভাবে এ অঞ্চলে ক্রমান্বয়ে ইলমে হাদীসের সুবাতাস প্রবাহিত হয়।

বাংলাদেশে দরসে হাদীসের সূচনা:
বাংলাদেশে ৬৬৮ হিজরী মোতাবেক ১২৭০ খ্রিষ্টাব্দে হযরত শাহ শরফুদ্দীন আবু তাওয়ামা রহ. ঢাকার অদূরে সোনারগাঁয়ে সর্বপ্রথম ইলমে হাদীসের দরস দেয়া শুরু করেন। সেখানে তিনি একটি মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করে; প্রায় ৪৫ বছর হাদীসের দরস প্রদান করেন। তারপর শায়খ তাকী রহ. মসজিদে ইলমে হাদীসের দরস দেন। এভাবে হিজরী ১৩ শতাব্দি পর্র্যন্ত দরসের ধারা চলতে থাকে। কিন্তু এ পর্যন্ত সবকিছুই ছিল ব্যক্তিকেন্দ্রিক। অতঃপর বাংলাদেশের সমুদ্র বন্দর চিটাগাংয়ে একটি ইসলামী বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হয়। আর সেখানেই ১৩২৬ হিজরীতে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে সর্বপ্রথম কুতুবে সিত্তাহ, মুয়াত্তাইন ও তাহাবী শরীফসহ আরো বিভিন্ন কিতাবাদির দরস শুরু হয়। সেই বিদ্যালয় আজ ‘জামিয়া আহলিয়া দারুল উলূম মুঈনুল ইসলাম হাটহাজারী’ নামে পরিচিত।

বৃটিশ বেনিয়াদের আগমন এবং মাদরাসা নির্মূল:
ঐতিহাসিক সত্য, বৃটিশ শাসনামলের পূর্বে কেবল বাংলার ভূখণ্ডেই ৮০ হাজার কওমী মাদরাসা ছিল। ভাগ্যের নির্মম পরিহাস, ১৭৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধে বাংলার শেষ নবাব স্বাধীনতার জ্যোতির্ময় সূর্য সিরাজুদ্দৌলার পরাজয়ের মধ্য দিয়ে এদেশে মুসলিম শাসনামলের অবসান ঘটে এবং সমগ্র ভারতবর্ষে একচ্ছত্রভাবে বৃটিশ বেনিয়াদের আধিপত্য সুপ্রতিষ্ঠিত হয়। যার ফলে ধর্মীয়, সামাজিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও শিক্ষা-দীক্ষার ক্ষেত্রে উপমহাদেশের মুসলিম সমাজ প্রায় পঙ্গু হয়ে পড়ে। ইংরেজরা ষড়যন্ত্র করে গোটা উপমহাদেশের মসজিদ, মাদরাসা ও খানকাহসমূহের তাবৎ ওয়াকফ সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করে ফেলে। যার দরুন এসব ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলো মুখ থুবড়ে পড়ে। ১৮৫৭ সালে ইংরেজ বিরোধী জিহাদে শামেলীর ময়দানে এদেশের আলেম-উলামা, পীর-মাশায়েখগণের একসাগর রক্ত বিসর্জন দেয়ার পরও যখন উপমহাদেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষা করা সম্ভব হয়নি। ঠিক তখনি তৎকালীন সময়ের দূরদৃষ্টি সম্পন্ন সর্বজনশ্রদ্ধেয় আলেমগণ, ভারতের উত্তর প্রদেশের দেওবন্দ নামক স্থানে ১৮৬৬ সালে ‘দারুল উলূম দেওবন্দ’ নামে একটি ক্বওমী মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করেন। এই দেওবন্দ মাদরাসাকে কেন্দ্র করে পরবর্তীকালে উপমহাদেশে, ইউরোপ, আমেরিকা ও আফ্রিকায় তথা বিশ্বজুড়ে স্থাপিত হয় ছোট-বড় অসংখ্য দ্বীনি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। যা সমাজে ‘ক্বওমী’ মাদরাসা হিসেবে পরিচিত। যেগুলো পরিচালিত হয়, কওম বা মুসলিম জাতির সহায়তায়। এরই ধারাবাহিকতায় হযরত শাহ জালাল ও শাহপরাণ রহ. সহ ৩৬০ আওলিয়ার পদধূলিতে ধন্য পূণ্যভূমি সিলেটের প্রাণকেন্দ্রে কতোয়ালি থানাধীন শামীমাবাদ আবাসিক এলাকায়- উলামায়ে কেরাম, বুর্জগানে দ্বীন ও মুরুব্বিয়ানদের সুপরামর্শে বিগত ১০/১০/২০২০ইং তারিখে প্রতিষ্ঠা লাভ করে ‘জামিয়া ইসলামিয়া আরাবিয়া শামীমাবাদ সিলেট’। যা বিশ্বখ্যাত ইসলামী বিদ্যাপীঠ দারুল উলূম দেওবন্দের আদর্শের অনুসারী একটি ইসলামী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান।

শিক্ষাধারা:
জামেয়া শামীমাবাদ গতানুগতিক কোন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নাম নয়। সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা নিয়ে জামেয়া সাজিয়েছে তার পাঠদান পদ্ধতি। শিশুশ্রেণী থেকে শুরু করে দ্বীনী শিক্ষার সর্বোচ্চ স্তর তথা দাওরায়ে হাদীস এবং তৎপরবর্তী তাখাস্সুসাত (ইফতা, উলূমে হাদীস, উলূমে তাফসীর ও আদব) পর্যন্ত শ্রেণীভিত্তিক পাঠদানের রূপরেখাকে সামনে রেখে আল্লাহ পাকের অশেষ মেহেরবানিতে অতি অল্পসময়ে জামেয়া ধারাবাহিকভাবে ফযীলত ২য় বর্ষ (মিশকাত শরীফ) পর্যন্ত শিক্ষাকার্যক্রম চালু করতে সক্ষম হয়েছে। এরই অংশ হিসেবে আগামী বছর (১৪৪২-৪৩ হিজরী মোতাবেক ২০২০-২১ইং) রমজানের পর থেকে আদব বিভাগ চালু করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে। পাশাপাশি ইসলামের ইতিহাস, আরবী ও বাংলা সাহিত্যসহ যুগোপযোগী নানামুখী কার্যক্রম যথাযথ বাস্তবায়ন করে, আল্লাহমুখী যোগ্যতাসম্পন্ন একঝাঁক বিচক্ষণ তালিবুল ইলম জাতিকে উপহার দেয়ার সুখ্যাতি ইতোমধ্যে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে ছড়িয়ে পড়েছে। এছাড়াও সুবিন্যস্ত সিলেবাসের ভিত্তিতে পর্যায়ক্রমে মৌলিকভাবে কুরআন, হাদীস, ফিক্বহ, তাফসীর, উসূল-আকাঈদ এবং বৈষয়িক পর্যায়ে আরবী সাহিত্য, বাংলা সাহিত্য-ব্যাকরণ, নাহু, সরফ, বালাগাত-মানতেকসহ প্রয়োজনীয় ইংরেজী, গণিত, ইতিহাস ও ভূগোল ইত্যাদি সমুদয় বিষয় যথেষ্ট গুরুত্বের সাথে শিক্ষা দিয়ে যাচ্ছে।

ইলমে দ্বীন হাসিল করার পর জনসমাজে ইসলামী শিক্ষার সুফল পৌঁছে দেয়ার মহান লক্ষ্যকে সামনে রেখে জামেয়া সময়ে সময়ে নানামুখী কর্মসূচি গ্রহণ করে থাকে। সবমিলিয়ে জামেয়া ইসলামিয়া আরাবিয়া শামীমাবাদ বহু বিভাগ সমন্বিত একটি মহাপ্রকল্প।

জামেয়ার সাধারণত দুটি বিভাগ রয়েছে:
১. শিক্ষা বিভাগ ২. অর্থ বিভাগ।
শিক্ষা বিভাগটির কার্যক্রম দু’ভাবে পরিচালিত হয়:
ক. ক্লাসভিত্তিক পাঠদান খ. সামষ্টিকভাবে প্রশিক্ষণ।

প্রথমটি আবার ৪ ভাগে বিভক্ত:
যথা: ১. হিফজ বিভাগ ২. নূরানী বিভাগ  ৩. কিতাব বিভাগ ও ৪. আরবী ভাষা ও সাহিত্য বিভাগ ।
১. হিফজ বিভাগ: উক্ত বিভাগটিতে মোট ৫টি জামাত রয়েছে। যথা: হিফজ নাযেরা, হিফজ আওয়াল, হিফজ ছানী, হিফজ ছালীছ ও হিফজ তাকমীল।

রেজাল্টের বিবেচনায় উল্লেখযোগ্য স্থান অর্জন করার মাধ্যমে এ বিভাগটি ইতোমধ্যে জামেয়াকে গোটা বাংলাদেশসহ বহির্বিশ্বেও পরিচিত করে তোলেছে। মক্তব ও প্রাইমারি থেকে আসা ছোট ছোট শিশুদেরকে অত্যন্ত যতেœর সাথে সাধারণত মাত্র তিন বছরে সম্পূর্ণ কুরআন শরীফ মুখস্থ করানোর চেষ্টা করা হয় এবং হিফজ সমাপনকারী ছাত্রদের কিতাব বিভাগে ভর্তির জন্য বিশেষ প্রশিক্ষণের মাধ্যমে উপযুক্ত করে গড়ে তোলা হয়।

নূরানী বিভাগ: এ বিভাগে নূরানী তা’লীমুল কুরআন বোর্ডের অধীনে শিশু শ্রেণী থেকে ১ম, ২য় ও ৩য় শ্রেণী পর্যন্ত দক্ষ-ট্রেনিংপ্রাপ্ত শিক্ষকমণ্ডলী দ্বারা সহীহ-শুদ্ধভাবে কুরআন শরীফ তেলাওয়াত, আমপারা ও অর্থসহ ৪০টি হাদীস মুখস্ত করানো হয়। পাশাপাশি অত্যাবশ্যকীয় মাসআলা-মাসাইলসহ প্রাথমিক বাংলা, উর্দূ, গণিত, ইংরেজী ইত্যাদিও যত্নের সাথে শেখানো হয়।

কিতাব বিভাগ: এ বিভাগটিতে মক্তব চাহারম থেকে ফযীলত ২য় তথা মিশকাত শরীফ পর্যন্ত ধারাবাহিকভাবে শ্রেণীভিত্তিক পাঠদান ব্যবস্থা চালু রয়েছে। যেখানে রাত-দিন সার্বক্ষণিক পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে নিরলসভাবে মেহনত করে যাচ্ছেন একঝাঁক তরুণ আলেমে দ্বীন। বিশেষত: এটিই জামেয়ার শিক্ষা বিভাগের সর্বাধিক সমৃদ্ধ, বৃহত্তর ও প্রধান বিভাগ। মূলত এ বিভাগটিই যোগ্য আলেমে দ্বীন তৈরী হওয়ার অন্যতম মাধ্যম।

আরবী ভাষা ও সাহিত্য বিভাগ: এ বিভাগে দু’টি ফরীক রয়েছে-

ফরীকে আউয়াল:
নাহু-সরফে দূর্বল, শুদ্ধ করে আরবী ইবারত পড়তে অক্ষম এমন ছাত্রদের জন্য “আরবী ভাষা ও নাহু-সরফের সমন্বয়ে” এই ফরীক থাকবে।

ফরীকে সানী:
“উচ্চতর আরবী ভাষা ও সাহিত্য বিভাগ”- নাহু ও সরফে সবল, দ্রুত ও শুদ্ধভাবে ইবারত পড়তে সক্ষম, আরবী সাহিত্যের প্রতি আগ্রহী এমন ছাত্রদেরকে এই ফরীকে ভর্তি করা হবে ইনশাআল্লাহ্।

জামেয়ার সামষ্টিক ছাত্র প্রশিক্ষণ কর্মসূচি:
দ্বীন ও সমাজের সকল পরিসরে আমাদের সন্তানরা যেন ভূমিকা রাখতে পারে; এজন্য রয়েছে আমাদের নানামুখী আয়োজন। এসব আয়োজনকে বাস্তবরূপ দানের জন্য জামেয়ার মেধাবী ছাত্রদের সমন্বয়ে গঠন করা হয়েছে “আস-সুন্নাহ ছাত্র সংসদ” নামে একটি অরাজনৈতিক ছাত্র সংগঠন। যার মাধ্যমে পরিচালিত হয় নিম্নোক্ত বিভাগসমূহ:

(ক) ছাত্র সংসদ পাঠাগার: পাঠ্যপুস্তকের পাশাপাশি ছাত্রদের জ্ঞানের পরিধি আন্তর্জাতিক মানে উন্নয়নের লক্ষ্যে সমকালীন অবস্থা ও আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপট সম্পর্কে অবগতির জন্য তথ্যবহুল বই-পুস্তক সমৃদ্ধ একটি উঁচুমানের পাঠাগার তৈরীর প্রচেষ্টা অনেকখানি সফলতার পথে।

(খ) বক্তৃতা প্রশিক্ষণ: ইলম অর্জনের পাশাপাশি তা সুন্দর ও সাবলীলভাবে সাধারণ মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেয়ার লক্ষ্যে জামেয়ার ‘আস-সুন্নাহ ছাত্র সংসদ’ আয়োজন করে প্রশিক্ষণমূলক সাপ্তাহিক বক্তৃতা সভার। যার ফলস্বরূপ প্রতি বৎসরই আলহামদুলিল্লাহ এমন অনেক ছাত্র বের হয়; যারা বিষয়ভিত্তিক আরবী, বাংলা ও ইংরেজী ভাষায় অনর্গল বক্তব্য রাখতে সক্ষম।

(গ) বাৎসরিক প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠান:
এতে ছাত্রদের মেধা বিকাশের জন্য বিভিন্ন বিষয় ধার্য্য করা হয় এবং নির্ধারিত বিষয়ে প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করে বক্তৃতা দানের মাধ্যমে ছাত্ররা নিজেদের সুপ্ত প্রতিভার বিকাশ ঘটাতে সক্ষম হয়।

(ঘ) দেয়ালিকা:
পাশ্চাত্যঘেঁষা বিকৃত রুচির কলমব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে ইসলামী সাহিত্যের নির্মল জ্যোতি বিকিরণের মহান লক্ষ্য নিয়ে জামেয়ার ছাত্রদেরকে কলম সৈনিক রূপে গড়ে তোলার জন্য বছরে দু’বার নিয়মিত বাংলা ও আরবী দেয়ালিকা প্রকাশ করার উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে।

জামেয়ার সেবাপ্রকল্প:
১. ফাতাওয়া-ফারায়েজ বিভাগ: ধর্মীয় ও বিভিন্ন ধরনের উদ্ভূত সমস্যার শরয়ী সমাধানকল্পে দক্ষ মুফতী সাহেবগণ বিনিময়হীন এই খেদমত আঞ্জাম দিয়ে থাকেন।
২. দাওয়াত: উক্ত বিভাগে সাধারণ মানুষকে দ্বীন শিখানো এবং আমলী জিন্দেগী গড়ার জন্য জোর দেয়া হয়। পাশাপাশি উস্তাদ-ছাত্রসহ সাধারণ মানুষের আত্মশুদ্ধির জন্য বিশ্ববরেণ্য উলামা-মাশায়েখগণকে দাওয়াত করে নসিহতের ব্যবস্থা করা হয়।

৩. রচনা ও প্রকাশনা: অধুনা সাহিত্যাঙ্গনগুলো তথাকথিত বুদ্ধিজীবিদের দখলে। তাদের নৈতিকতা বিবর্জিত সাহিত্য পড়ে যুব সমাজের চরিত্র হচ্ছে কলুষিত। তাই যুব সমাজকে নৈতিক অবক্ষয় থেকে উদ্ধার করা, পাশাপাশি বাংলা ভাষাভাষী আপামর মানুষের কাছে ইসলামিক কালচার ও কুরআন-সুন্নাহর অমীয় বাণী পৌঁছে দেয়ার মহান ব্রতে নিরলস কাজ করে যাচ্ছে জামেয়া শামীমাবাদ।
সেদিন বেশি দূরে নয়; যেদিন সাহিত্যের ময়দানেও আমাদের এই জামেয়া অতুলনীয় অবদান রাখতে সক্ষম হবে, ইনশাআল্লাহ!
৪. দুস্থ মানবতার সেবা: জামেয়ার স্বেচ্ছাসেবী ছাত্র-শিক্ষকগণ লেখাপড়ার পাশাপাশি আর্ত মানবতার সেবায় সদা তৎপর। জামেয়ার পক্ষ থেকে গরীব, দুস্থ, অসহায় ও দূর্যোগকালীন সময়ে দেশের বিপদগ্রস্থ মানুষের সেবায় তারা উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করে থাকেন।
২. জামেয়ার অর্থ বিভাগ: এ বিভাগটি বর্তমানে ৪টি ফান্ডের সমন্বয়ে পরিচালিত হচ্ছে: (১) সাধারণ ফান্ড, (২) গরীব ফান্ড, (৩) কিতাব ফান্ড ও (৪) মসজিদ ফান্ড।

১. সাধারণ ফান্ড: এ ফান্ড থেকে উস্তাদগণের বেতন-ভাতা, বোর্ডিংসহ যাবতীয় খরচ বহন করা হয়, কাজেই উক্ত ফান্ড জামেয়ার অর্থ বিভাগে সর্ববৃহৎ এবং অন্যতম।

২. গরীব ফান্ড: এ ফান্ড থেকে গরীব, এতীম-মিসকীন ছাত্রদের ভরণপোষণ, চিকিৎসা ও কিতাবাদি ক্রয়সহ সার্বিকভাবে সহযোগিতা করা হয়।

৩. কিতাব ফান্ড: এ ফান্ড থেকে মাদরাসার দরসী-গায়রে দরসী প্রয়োজনীয় যাবতীয় কিতাবাদি ক্রয় করা হয়।

৪. মসজিদ ফান্ড: এ ফান্ড থেকে মসজিদের জমি ক্রয়সহ মসজিদ নির্মাণ সংক্রান্ত যাবতীয় খরচ আঞ্জাম দেয়া হয়।

বৈশিষ্ট্যাবলী:
১. তা’লীমের পাশাপাশি তারবিয়াতের প্রতিও গুরুত্ব দেয়া।
২. দেশ-বিদেশের খ্যাতনামা প্রতিষ্ঠানগুলোর বাছাইকৃত ফুযালাদের দ্বারা গঠিত উস্তাদ স্টাফ।
৩. সুদক্ষ আসাতিযায়ে কেরামের তত্ত্বাবধানে ২৪ ঘণ্টার রুটিন।
৪. দক্ষ ও প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত হাফেজ সাহেবগণের নিরলস তত্ত্বাবধানে।
৫. সার্বক্ষণিক সি.সি. টিভি নিয়ন্ত্রিত।
৬. সম্পূর্ণ আলাদা ব্যবস্থাপনায় হিফজ নাযেরা ও তাকমীল বিভাগ।
৭. সম্পূর্ণ আবাসিক ব্যবস্থাপনা।
৮. প্রতি বৃহস্পতিবার বাদ এশা ইসলাহী তারবিয়াতী বয়ান করত: দেশ-জাতি, বিশেষ করে জামেয়ার সাহায্যকারী শুভাকাঙ্খী ও হিতাকাঙ্খী ভাই-বোনদের জন্য দুআর ব্যবস্থা করা হয়।
৯. পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার পাশাপাশি উন্নত ও মনোরম পরিবেশ।
১০. মাসিক মজলিসে ইলমী এবং প্রতি সোমবার বাদ আসর সাপ্তাহিক উস্তাদ সমন্বয় মজলিস থেকে মাশওয়ারা ভিত্তিক জামেয়ার ইলমী-আমলী সার্বিক কার্যক্রম পরিচালনা করা।

জামেয়ার ভবিষ্যত পরিকল্পনা:
১. দাওরায়ে হাদীস (মাস্টার্স) ও তৎপরবর্তী তাখাস্সুসাত খোলার মাধ্যমে শিক্ষাব্যবস্থার স¤প্রসারণ করা।
২. ছাত্রদের বহুমুখী জ্ঞানার্জনের অংশ হিসেবে কম্পিউটার কোর্স চালু করা।
৩. জামেয়ার সমাজকল্যাণ সংস্থার মাধ্যমে গরীব-দুঃখী অসহায় মানুষের সেবায় এগিয়ে আসা।
৪. লাশ গোসলের ব্যবস্থাসহ অসহায় দুঃস্থ মানবতার সেবায় ফ্রি এম্বুলেন্স সার্ভিস চালু করা।
৫. পয়েন্ট ভিত্তিক মক্তব চালু করা এবং বয়স্কদের জন্য দ্বীনি শিক্ষার ব্যবস্থা করা।
৬. জামেয়ার মসজিদ এবং পৃথক ছাত্রাবাসের ব্যবস্থা করা।
৭. জামেয়ার ছাত্রদের পরীক্ষা এবং সাপ্তাহিক সভার জন্য হল নির্মাণ ও পৃথক পাঠাগারের ব্যবস্থা করা।
৮. মেধাবী ছাত্রদের জন্য বৃত্তিপ্রদান ট্রাষ্ট গঠন করা।
৯. আধুনিক শিক্ষার সমন্বয়ে মানসম্পন্ন মহিলা মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করা।
১০. ইসলামিক আইডিয়াল স্কুল প্রতিষ্ঠা করা।

জামেয়ার ইলমী-আমলী দৈনন্দিন কার্যক্রম

হিফজ বিভাগ:
শেষ রাতে তাহাজ্জুদের নামায আদায় করার পর থেকে হিফজ বিভাগের ছাত্রদের ক্লাস শুরু হয়ে ০৭:৫০ মিনিট পর্যন্ত চলে। ০৭:৫১ মিনিটে নাস্তার বিরতি; ০৮:৩০মিনিট পর্যন্ত। ০৮:৩১ মিনিট থেকে ০৯:১৫ মিনিট পর্যন্ত গোসল। ০৯:১৬ মিনিট থেকে ১২:০০ টা পর্যন্ত ঘুমের বিরতি। ১২:০১ মিনিট থেকে ০১:২০ মিনিট পর্যন্ত ক্লাস। ০১:২১ মিনিট থেকে ০২:৩০ মিনিট পর্যন্ত যোহরের নামায এবং দুপুরের খাবার। ০২:৩১ মিনিট থেকে আসরের নামাযের ১৫ মিনিট পূর্ব পর্যন্ত ক্লাস। মাগরিবের নামাযের পর সূরায়ে ওয়াকি¦য়া তেলাওয়াত এবং ০৮:৪৫ মিনিট পর্যন্ত ক্লাস। ০৮:৪৬ মিনিট থেকে ০৯:৩০ মিনিট পর্যন্ত এশার নামায এবং রাতের খাবার। ০৯:৩১ মিনিট থেকে ১০:৩০ মিনিট পর্যন্ত ক্লাস। অতঃপর ঘুম।

নূরানী বিভাগ:
ফজর নামাযের পর সূরায়ে ইয়াসীন তেলাওয়াত। এরপর ০৭:৫০ মিনিট পর্যন্ত উস্তাদগণের নেগরানীতে পড়া। ০৭:৫১ মিনিট থেকে ০৮:৩০ মিনিট পর্যন্ত নাস্তা। ০৮:৩১ মিনিট থেকে ধারাবাহিক ক্লাস ০১:২০ মিনিট পর্যন্ত। ০১:২১ মিনিট থেকে ০২:৩০ মিনিট পর্যন্ত যোহরের নামায, দুপুরের খাবার এবং গোসল। ০২:৩১ মিনিট থেকে ০৩:০০ টা পর্যন্ত উস্তাদগণের নেগরানীতে পড়া। ০৩:০১ মিনিট থেকে আসর পর্যন্ত বিশ্রাম। অতঃপর মাগরীবের পর থেকে ০৮:৪৫ মিনিট পর্যন্ত উস্তাদগণের নেগরানীতে পড়া। ০৮:৪৬ মিনিট থেকে ০৯:৩০ মিনিট পর্যন্ত এশার নামায এবং রাতের খাবার। ০৯:৩১ মিনিট থেকে ১০:৩০ মিনিট পর্যন্ত উস্তাদগণের নেগরানীতে পড়া। অতঃপর ঘুম।

কিতাব বিভাগ:
ফজরের নামায আদায় করত: সূরায়ে ইয়াসীন তেলাওয়াত। ফজরের পর থেকে মুতালাআ। সকাল ০৭:০০ টা থেকে ক্লাস শুরু হয়ে ০৭:৫০ মিনিট পর্যন্ত। ০৭:৫১ মিনিট থেকে ০৮:২০ মিনিট পর্যন্ত সকালের নাস্তা। এরপর ০৮:২১ মিনিট থেকে ধারাবাহিক দরস দুপুর ১২:৫০ মিনিট পর্যন্ত। ১২:৫১ মিনিট থেকে ০২:৩০ মিনিট পর্যন্ত গোসল, যোহরের নামায ও দুপুরের খাবার। ০২:৩১ মিনিট থেকে ০৩:০০ টা পর্যন্ত তাকরার/হাতের লেখা। ০৩:০১ মিনিট থেকে আসর পর্যন্ত বিশ্রাম। মাগরিবের নামাযের পর থেকে ০৮:৪৫ মিনিট পর্যন্ত উস্তাদগণের নেগরানীতে তাকরার/মুতালাআ। ০৮:৪৬ মিনিট থেকে ০৯:৩০ মিনিট পর্যন্ত এশার নামায এবং রাতের খাবার। ০৯:৩১ মিনিট থেকে ১১:৩০ মিনিট পর্যন্ত উস্তাদগণের নেগরানীতে মুতালাআ। অতঃপর ঘুম।

সকল বিভাগের ছাত্রদের ইজতেমায়ী আমল:
* বাদ নামাযে ফজর সূরায়ে ইয়াসীন তেলাওয়াত।
* বাদ নামাযে যোহর খতমে খাজেগান ও দুআ।
* বাদ নামাযে আসর সূরায়ে মুয্যাম্মিল তেলাওয়াত, শরীর চর্চা ও সাপ্তাহিক দাওয়াতের আমল।
* বাদ মাগরিব সূরায়ে ওয়াক্বিয়া তেলাওয়াত।
* বাদ নামাযে এশা সূরায়ে মুলক তেলাওয়াত।
* প্রতি বুধবার বাদ যোহর সুন্নাতের আমলী প্রশিক্ষণ।
* প্রতি বৃহস্পতিবার বাদ এশা ইসলাহী বয়ান ও জামেয়ার আজীবন সদস্য-শুভাকাঙ্খী তথা সমস্ত মুসলিম উম্মাহর জন্য দুআর ব্যবস্থা করা হয়।
* প্রতি শুক্রবার সূরায়ে কাহাফ এবং বাদ আসর বিশেষ দরূদ শরীফের আমল করা হয়।

এই হচ্ছে জামেয়ার দৈনন্দিন কার্যক্রমের সারসংক্ষেপ।
বি.দ্র.: উক্ত রুটিন স্থায়ী বা অপরিবর্তনীয় নয় বরং সময়ের পরিবর্তনে তা পরিবর্তন করার অবকাশ রয়েছে।

শেষকথা:
মনোরম ও আবাসিক পরিবেশে যুগের কিংবদন্তি হাফিজ মাওলানা সৈয়দ শামীম আহমদ দা.বা. এর সার্বিক তত্ত্বাবধানে অভিজ্ঞ শিক্ষকমণ্ডলীর আন্তরিক প্রচেষ্টায় পরিচালিত এ জামেয়া সাবলীল গতিতে এগিয়ে চলছে তার অভিষ্ট লক্ষ্য পানে। দেশ জাতি ও দ্বীনের কল্যাণে জামেয়া ইসলামিয়া আরাবিয়া শামীমাবাদের কর্মকাণ্ড হোক আরো গতিময় ও সাফল্যমণ্ডিত। আমীন।

আকুল আবেদন!

প্রিয় দ্বীন দরদী ভাই-বোনেরা!
জামেয়া শামীমাবাদের সম্মানিত মুহতামিম হাফিজ মাওলানা সৈয়দ শামীম আহমদ দা. বা. ও আসাতিযায়ে কেরাম সুদুর প্রসারী প্ল্যান নিয়ে অভিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছার জন্য দিবা-রাত্রি নিরলসভাবে মেহনত করে যাচ্ছেন। দ্বীনের সঠিক শিক্ষাকে সমাজে ছড়িয়ে দেয়ার এ মেহনতে আপনারাও মেধা-শ্রম-অর্থ, পরামর্শ ও সহযোগিতার মাধ্যমে এগিয়ে আসুন। আমাদের সম্মিলিত চেষ্টায় গড়ে উঠবে নববী আদর্শে উজ্জীবিত সমাজ। আল্লাহ পাক আমাদের সহায় হোন, আমীন!